শুদ্রশিক্ষা - করোনাকালে অতীতমুখে (প্রথম পর্ব)
রাণা হাজরা
পূর্বে বিদ্যালাভের অধিকারী ছিল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা। বৈশদের সীমিত অনুমতি থাকলেও, শুদ্রদের ক্ষেত্রে বেদের স্তোত্র কানে গেলে গরম ঘি ঢেলে দেওয়ার নিদান ছিল। এই বঙ্গের মত প্রবল চেতনাসমৃদ্ধ স্থানেও শুদ্রের সাথে একাসনে বসার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের প্রবল শুচিবাই ছিল। ফলত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আমলেও শুদ্র শিক্ষাদান জনপ্রিয় হয়নি।
প্রাকবৃটিশ পর্বে হিন্দুদের শিক্ষাদানের মূল কেন্দ্র ছিল টোল ও পাঠশালা। উচ্চবর্ণ ছাড়া যে স্থানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার ছিল না। ভারতে ব্রাহ্মণদের সংখ্যা আনুমানিক ৫ শতাংশের নীচে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার (৩০ জুলাই, ২০২১) প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের প্রাথমিক স্কুলগুলো বিশ্লেষিত তথ্যে প্রায় ৪৫% অন্যান্য অনগ্রসর জাতি, ১৯% সংরক্ষিত জাতি, ১১% সংরক্ষিত আদিবাসী। যদিও মন্ডল কমিশন দাবি করেছিল ভারতে ৫০%-র বেশি অন্যান্য অনগ্রসর জাতি। তবুও এটুকু মেনে নিতেই হবে ভারতীয় জনসংখ্যার সিংহভাগ জলঅচল শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
বৃটিশ জমানার জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে পুরুষ সাক্ষরতার হার ৮.১% এবং নারী সাক্ষরতার হার ০.৩৫%, সংযুক্ত হার ৪.৩২%। হয়তো বিপরীত মত থাকবে। শতাংশ কিছু কম বা বেশি হতে পারে। তবে পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবতার অনেক মিল। নারীদের শিক্ষা সেই সময়েও অবহেলিত ছিল। আর শূদ্রদের জ্ঞানলাভ অপরাধ ছিল।
স্বঅভিজ্ঞতা ও স্মৃতিচারণে দেখতে পায় আমার শৈশবে প্রায় সমস্ত উচ্চবর্ণের প্রায় সমস্ত বৃদ্ধারাই অক্ষরজ্ঞানশূন্য ছিলেন। পয়সার মূল্য বুঝতেন আকার দেখে, কুড়ি গণকিয়া দিয়ে হিসেব করতেন। যাদের সবার জন্ম স্বাধীনতার ওপারে। উচ্চবর্ণের নারীদের যদি এই অবস্থা হয়, তবে শূদ্র নারীদের অবস্থা যে তথৈবচ হবে তা বলাইবাহুল্য।
অতএব উচ্চবর্ণের ও লিঙ্গের হারের সাথে সাক্ষরতার হারে এক সমতা দেখা যায়। ১৯৩১ সালে এসেও সর্বমোট সাক্ষরতার হার ১০% পার করেনি। স্বাধীনতার আড়াই দশক পরেও সাক্ষরতার হার ৩০% পার করেনি (১৯৭১ সালের জনগণনা)।
স্বাধীন দেশের মূল কর্তব্য যেখানে জনগণকে শিক্ষিত করা, সেখানে প্রধান বিষয়টি চূড়ান্ত অবেহেলিত হল। ১৯৭১ সালে এসে নিশ্চিন্তে বলা যায়, স্বাধীন দেশে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎপাটিত হয়নি, তাই উচ্চবর্ণের রক্তচক্ষু এড়িয়ে ভারতের আদিম অধিবাসীদের পক্ষে বিদ্যালয়ে পা দেওয়া সম্ভব ছিল না।
ভারতের এই বিপুল জনসংখ্যাকে পদদলিত রাখার প্রধান ধাপ শিক্ষা থেকে বঞ্চনা। তাতে হয়তো রাষ্ট্রিক শাসকেরা লাভবান হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র কল্যাণকামী হতে পারেনি।
চীনের প্রভূত উন্নতি দেখে যারা চোখ কচলান ও বিভিন্ন তত্ত্বের অবতারণা করেন, সেই চীনদেশেও শিক্ষার হার যেখানে প্রায় ৯৬ শতাংশ, ভারতে ৮১%।
(শেষটুকু পরবর্তী পর্বে)
2 মন্তব্যসমূহ
Nothing to learn new from this article.
উত্তরমুছুনআগে জানা হলেও তথ্যসমৃদ্ধ লেখা- বার বার জানা ও জানানো সবসময়ই প্রয়োজন। তবেই বর্তমান কে বিশ্লেষণ করতে পারব তারপর....
উত্তরমুছুন