শুদ্রশিক্ষাঃ করোনাকালে অতীতমুখে (দ্বিতীয় পর্ব)
রাণা হাজরা
শিক্ষা আনে চেতনা
চেতনা আনে বিপ্লব
শুধু শিক্ষা দিয়ে বিপ্লব হয় না। গুটিকয় মানুষের মধ্যে যদি শিক্ষা আবদ্ধ থাকে, তা কোনরূপ বদ্ধজলায় ঢেউ তুলতে পারে না। উনবিংশ শতকে রামমোহন-বিদ্যাসাগরের হাত ধরে যে বাংলায় নবজাগরণ ও আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষায় পদার্পন, তা শুধুমাত্র শহর ও মধ্যবিত্ত কেন্দ্রিক। তাই ওই ১০%-র বেশি জনসংখ্যা পরাধীনতার যন্ত্রণা অনুভব করলেও এবং সশস্ত্র বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করলেও, তা পরাধীনতার শৃঙ্খল উন্মোচনে যথেষ্ট ছিল না। কারণ তখনো গ্রামীণ শিক্ষার বড় অংশ টোল ও গুরুনির্ভর। আর ভারতীয় জনসংখ্যার আধার, তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় শ্রেণি তখনো শিক্ষা থেকে বহুদূরে।
জনগণের বিপুল অংশ শিক্ষিত হলে তা শাসকের, সুবিধাভোগী শ্রেণির উৎকন্ঠার কারণ হয়। অতএব ভারতীয় শাসক, পুরোহিতবর্গ ও মধ্যস্বত্বভোগীগণ এই বিপুল জনগণকে নিয়ন্ত্রণের মন্ত্র আয়ত্ত করে ফেলেছিল। শিক্ষা থেকে দূরে রাখা এবং পশুতুল্য জীবনের দিকে ঠেলে শুদ্রশ্রেণিকে শতকের পর শতক পদদলিত করে রেখেছিল। এই সময়ে এসেও ভারতীয় দলিত বা শুদ্র শ্রেণি রাষ্ট্র কর্তৃক কতটুকু মানবিক ব্যবহার লাভ করে, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ জাগ্রত হয়।
আমাদের বাড়িতে যিনি দুধ দিতে আসেন তিনি ব্রাহ্মণ। কথাপ্রসঙ্গে তিনি জানালেন, ব্রাহ্মণরা হিন্দু নয়। আমরা সনাতন ধর্মের লোক। হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণের সাথে সনাতন ধর্মের মিল নেই। ওরা আলাদা, আমরা আলাদা। ওরা ও আমরা, এটাই ভারত। এই ভারত আগে ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণ এবং শুদ্র শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। এই বিদ্বেষ ও বৈষম্যকে কাজে লাগিয়ে শাসকেরা শাসন করে গেছে। ইংরেজদের অধীনে ছিল এক বিপুল ভারত। ভারত বিষয়ে অজ্ঞ বৃটিশরা পুরো ভারতকে হিন্দু ও মুসলিমে বিভক্ত করে দিলেন। ভারত ভারতীয় হয়ে থাকলে তা তাদের শাসনের পক্ষে যে বিপদঘন্টা হবে তা বুঝতেন। শুদ্র ও ব্রাহ্মণের আমরা-ওরা থেকে, ইংরেজ আমলে হিন্দু-মুসলিমে বিভক্ত হল। এই হিন্দুতে ব্রাহ্মণ, শুদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় সবাই পড়ে গেল। ব্রাহ্মণরা যে আলাদা নয়, হিন্দুধর্মের অংশ, তা অনেক ব্রাহ্মণ অনেকে মানতে পারে না। তাই এখনো বিদ্বেষ জেগে ওঠে। এখনো অস্বীকার করতে চায় যে আমরা হিন্দু। কিন্তু মুসলিমভীতি তাদেরকে এই বিচ্ছিন্নতা থেকে বিরত করে। তাই হিন্দুধর্মের বদলে হিন্দুত্ববাদ তৈরি হয়। কারণ হিন্দু বলে কোন ধর্ম নেই। হিন্দুদেরই পবিত্র গ্রন্থ বেদ, গীতা, রামায়ণ কোথাও হিন্দুধর্মের উল্লেখ নেই।
বাংলা অবশিষ্ট ভারতের থেকে চেতনায় উন্নত বলে শোনা যায়, কিন্তু কখনো এমন কি শুনেছেন যে বাঙালি ভট্টাচার্যের সাথে বাঙালি বাউরির বিয়ে হয়েছে?
বিদ্বেষ চাপা আছে, চলে যায়নি।
তাই শিক্ষায় সংরক্ষণ নিয়ে উচ্চবর্ণের প্রতিবাদ স্তিমিত হয় না। নাগপুরের সিংহাসনে ব্রাহ্মণ ছাড়া আজ অব্দি কেউ অধিষ্ঠিত হয় না।
শাস্ত্র অমোঘ। শাস্ত্রে কোন ভুল নেই। এই শাস্ত্রে লেখা আছে, যজ্ঞের সময় কেউ যদি ভুল করে শুদ্র বা কুকুরের দিকে তাকিয়ে ফেলে তবে যজ্ঞের অভীষ্ট লাভ থেকে যজমান বঞ্চিত হয় ও অপরাধ হিসেবে গণ্য হত।
শুদ্রের যে কেবল বেদপাঠ নিষিদ্ধ ছিল তাই নয়, শুদ্রের বাড়িতে ব্রাহ্মণদের বেদপাঠ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
শুদ্র মানে শুধু দাস। নব্বই শতাংশ দাসের একমাত্র কাজ ১০% উচ্চবর্ণের সেবা করা। এক বিপুল অংশের জনগণকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখে কোন সমাজ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পেতে পারে না।
(শেষটুকু পরবর্তী পর্বে)
0 মন্তব্যসমূহ