অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নিয়ে এসেছেন আরও এক জুমলা, জেনে নিন কি সেই জুমলা

ভাঁড়ে মা ভবানী
মণীশ রায়চৌধুরী



বিজয় মালিয়া, নীরব মোদী থেকে মেহুল চোকসি ভারতীয় ব্যাঙ্কে ঋণ নিয়ে বিদেশে ভাগলওয়া হওয়ার তালিকা ক্রমশ বর্ধমান।

এরসাথে আছে যাদের অর্থবলে বলীয়ান হয়ে আমাদের মাননীয় মোদীজি প্রধানমন্ত্রীর গদিতে আসীন হয়েছেন, আম্বানি-আদানির মত সেইসব ধনকুবের কর্পোরেট গ্রুপ, যাদের প্রতি তিনি এতটাই বন্ধুবৎসল যে প্রতি বছরই কোটি কোটি টাকা কর্পোরেট ট্যাক্স মাফ করে দিচ্ছেন।

ফলে অর্থনীতির ভাঁড়ে মা ভবানী।
কিন্তু সামনে উত্তরপ্রদেশের ভোট আসছে।

গত কয়েকটি রাজ্যে বিজেপির ভরাডুবি বুঝিয়ে দিয়েছে গোদি মিডিয়ার দৌলতে প্রধানমন্ত্রীর যে 'বাহুবলী' সুলভ ইমেজ তৈরি হয়েছিল তা আজ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত।

তাহলে উপায়!!

অতঃপর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নিয়ে এসেছেন আরও এক জুমলা তাতে নাকি অর্থনীতি একদম চাঙ্গা হয়ে উসেইন বোল্টের মতো দৌড়বে।

কী সেই উপায়?

ব্যাড ব্যাঙ্ক।

ব্যাঙ্কের সার্ভিস খারাপ হচ্ছে একথা গ্রাহকেরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন।

কিন্তু, ব্যাড ব্যাঙ্ক আবার কী?




আচ্ছা, তাহলে একটু খোলসা করেই বোঝানো যাক।

অর্থনীতি কে "চাঙ্গা" করতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী দুটি নতুন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান চালু করছেন 'ন্যাশনাল অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড' এবং 'ইন্ডিয়া ডেট রিজলিউশন কোম্পানি লিমিটেড'।

সে-তো বুঝলাম। কিন্তু, এরা করবেটা কী?

প্রথমটি ব্যাঙ্কের সমস্ত অনাদায়ী ঋণ বা অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেবে। ফলে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস থেকে তা মুছে গেল। পুরনো ঋণ আদায় না হওয়ার ফলে নতুন ঋণ দেওয়া যাচ্ছিল না, সেই সমস্যা না থাকায় তারা নতুন করে ঋণ দিতে পারবে, ব্যবসা-বাণিজ্যর শ্রীবৃদ্ধি হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি অনাদায়ী কোম্পানির থেকে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে যাবে, এমনকি তা আদায় না হলে কোম্পানির সম্পত্তি নিলাম করে তা আদায় করা হবে।

কত সহজ সুন্দর পথ তাই-না?




আরে মশাই দাঁড়ান, এখনই এত নাচবেন না। আগে পুরোটা বুঝুন।

১০০ টাকার অনাদায়ী ঋণের দায়ভার নিয়েই প্রথম সংস্থা ব্যাঙ্ককে ১৫ টাকা মিটিয়ে দেবে, আর বাকি ৮৫ টাকা মিটিয়ে দেওয়ার গ্যারান্টার থাকবে ভারত সরকার। আগামী ৫ বছরের ভিতর দ্বিতীয় সংস্থা ঐ ঋণ আদায়ে অসমর্থ হলে ৮৫ টাকার যতটা আদায় করতে পারবেনা ততটা সরকার ঐ ব্যাঙ্ককে মিটিয়ে দেবে।

অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন এই গ্যারান্টি মানি হিসাবে কেন্দ্র সরকার ৩০,৬০০ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে। তিনি জানিয়েছেন এই দুটি সংস্থার মিলিত রূপ বা ব্যাড ব্যাঙ্ক ২ লাখ কোটি টাকা এনপিএ'র দায়িত্ব নেবে। প্রাথমিকভাবে ব্যাঙ্ক গুলিকে ১৫% টাকা মিটিয়ে দিতে প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা লাগবে যা শুধু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতির অপেক্ষায় আছে।

বিষয়টি বুঝতে আরও কিছু পরিসংখ্যানের সাহায্য নেওয়া যাক।

অর্থমন্ত্রকের তথ্যানুযায়ী ৩১ মার্চ ২০২১ এ ভারতে ব্যাঙ্ক গুলির এনপিএর পরিমাণ ছিল ৮,৩৪,৯০২ কোটি টাকা। ঐ তারিখেই ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ সালে ছিল যথাক্রমে ১০,৩৬,১৮৭ কোটি টাকা, ৯,৩৩,৭৭৯ কোটি টাকা, ৮,৯৬,০৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত কয়েক বছরে অনুৎপাদিত সম্পদ বা এনপিএ কমেছে। খুব ভাল কথা। কিন্তু, মজাটা হল এক ব্যক্তির আর-টি-আইয়ের জবাবে সরকার জানিয়েছে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ অর্থকে অনাদায়ী অর্থ ধরে নিয়ে অর্থমন্ত্রক 'রাইট অফ' করে দেয়, পাতি বাংলায় তামাদি ঘোষণা করে দেয়।

২০১৯-২৯ আর্থিক বর্ষে সরকার ১,৭৫,৮৭৭ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ এ ১,৩১,৮৯৪ কোটি টাকা 'রাইট অফ' করে দিয়েছে তার ফলেই এনপিএ কম দেখাচ্ছে।

আমাদের এটাও বিচার করতে হবে যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ফিন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২২ এর মার্চে এনপিএ প্রায় ৯.৮% বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এখনো বোঝেননি?
ভাবছেন শুধুই সংখ্যার কচকচি হচ্ছে।
তাহলে সোজা ভাষায় বোঝাচ্ছি।

মনে করুন নরেনবাবুর বন্ধু মুকেশবাবু ব্যাঙ্ক থেকে ১০০ টাকা ধার নিয়েও কিছুতেই শোধ দেননি।

এদিকে কোন কারণে দুপক্ষকেই নিজেদের অ্যাকাউন্টস ক্লিয়ার দেখাতে হবে। নরেনবাবু যেহেতু সরকারের মাথায় বসে আছেন তিনি 'ক', 'খ' নামে দুটি সংস্থা খুলে জানালেন 'ক' সংস্থা ব্যাঙ্কের ঋণের দায়ভার নিয়ে এখনই ১৫ টাকা মিটিয়ে দিচ্ছে আর ভবিষ্যতে বাকি ৮৫ টাকা মিটিয়ে দেওয়ার গ্যারান্টি দিচ্ছে। 'খ' সংস্থাকে তিনি মুকেশবাবুর থেকে ১০০ টাকা ফেরত আনার দায়িত্ব দিলেন। 'খ' যত টাকা মুকেশবাবুর থেকে আদায় করতে পারবেনা তত টাকা তিনি সরকারের তরফ থেকে ব্যাঙ্ককে মিটিয়ে দেবেন। ফলে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস ক্লিয়ার হওয়ায় তারা আবার মন খুলে মুকেশ, বিজয়, গৌতম, মেহুলবাবুদের ধার দিতে পারবে।

কারণ সরকার তো গ্যারান্টি দিচ্ছেই বছর শেষে সব হিসাব মিলিয়ে দেবে।
তাহলে, খেলাটা কী বুঝলেন?

নরেনবাবু মাছের তেলেই মাছ ভাজার মত সরকারের টাকা (যেটা আসলে আপনারই ট্যাক্সের টাকা) দিয়েই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সরকারের অনাদায়ী ঋণ শোধ করে দিলেন। কারণ, নরেনবাবুর সাথে উপরোক্ত বাবুদের যেরকম দোস্তি 'খ' সংস্থা কোনদিনই টাকা আদায় করতে পারবেনা। এভাবে বছরের পর বছর চক্রবৃদ্ধিহারে আপনারই টাকা শুষে নিয়ে ফুলেফেঁপে উঠবে মুকেশবাবু'দের সম্পদের পাহাড়।

আপনি বরং হিন্দু-মুসলিম নিয়ে মেতে উঠে "জাতীয়তাবাদী" ললিপপ চুষতে থাকুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ