কোটার কোচিং সেন্টার গুলো বর্ণাশ্রমের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, জেনে নিন কীভাবে

শুদ্রশিক্ষাঃ করোনাকালে অতীতমুখে
রাণা হাজরা

বিদ্যতঞ্চ নৃপতঞ্চ নৈব তুল্য কদাচন
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে
প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণেরা বিদ্যালাভ ও বিদ্যাদানের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু আর্থিক বিন্যাস অনুযায়ী বিদ্যালাভের বিধান বা ব্যবস্থা ছিল না। কর্ম অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস থাকলেও, একই শ্রেণির মধ্যে আর্থিক প্রভেদ থাকলেও সম্পর্কগত দিক দিয়ে একই শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য ছিল না বলে মনে হয়।

মহাভারতে যেমন দেখা যায় গোষ্ঠীপতি নন্দরাজার পালিত পুত্র কৃষ্ণের সাথে অন্য গোপালক বালকদের অবাধ সম্পর্ক।

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেও অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যাবে গ্রামের অতি ধনীর পুত্র ও রিক্সাচালকের পুত্র পাশাপাশি বসে শিক্ষালাভ করছে। দুই বন্ধুর দুস্তর আর্থিক ব্যবধান তাদের একই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষালাভে বৈষম্য তৈরি করছে না। আমিও সেই সরকারি বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত। এখনো আমার বন্ধুবৃত্তে যেমন শিক্ষক আছে, ডাক্তার আছে, তেমন চা বিক্রি করে, রিক্সা চালায় এমন বন্ধুও আছে।

অতি গরীবেরাও ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছে, প্রযুক্তিবিদ্যায় দেশের সম্মান উজ্জ্বল করেছে। কিন্তু আগামী শিক্ষাব্যবস্থা শুধু ধনীর সন্তানের জন্য হতে চলেছে।

বৈষম্য শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে। ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্তের সন্তানেরা ঝা-চকচকে বাতানুকূল আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ হবে, আরো একদল সরকারি বিদ্যালয়ে সাবেকি ব্যবস্থার অংশ হবে।

ফেরিওয়ালা সন্তানেরা আর বহুজাতিক কোম্পানির সেলসম্যানের সন্তানের সাথে একসাথে বসবে না, এক স্কুলে পড়বে না। শিশুরা প্রথম থেকেই শিখে নেবে 'আমরা ও ওরা'।


উচ্চশিক্ষা ধীরে ধীরে বিত্তবানেরা দখল করবে। রাজস্থানের কোটা বা দেশের অন্যান্য অংশে গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলো ঠিক করে দেবে কারা ডাক্তারি বা প্রযুক্তিবিদ্যায় পড়ার সুযোগ পাবে। গরীব চাষীও জমিজমা বিক্রি করে ছেলেকে কোটা পাঠায়, ছেলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ পাবে এই আশায়। তার পরের খরচা হতদরিদ্র বাবা কিভাবে বহন করবে? কোথাও থামতে হবে। অর্থ ছাড়া এই দেশে আর শিক্ষার চাকা গড়াবে না।

ডাক্তারি পড়ার জন্য বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো ভদ্রভাষায় ঘুষ নেয়। যে ধনী সন্তান (যোগ্য না অযোগ্য সেই প্রসঙ্গে গেলাম না) এক কোটি ঘুষ দিয়ে মেডিক্যালে ঢোকার সুযোগ পাবে এবং শিক্ষাগ্রহণের সময় আরো কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করবে, সে রোগীকে কোন নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবে ভাবতে পারেন?

চিকিৎসা আর কোন মহান পেশা থাকবে না, থাকছেও না। রোগী মানে অর্থ উপার্জনের যন্ত্র।

গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা কোথায় যাবে?

ঘুরিয়ে কি আমরা পুরনো বর্ণাশ্রম প্রথার দিকের এগোচ্ছি?

চাষীর ছেলে চাষী হবে, ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার, উকিলের ছেলে উকিল? আর্থিক সামর্থ্য ছাড়া উড্ডয়ন কি সম্ভব হবে না?

বিদ্বানের প্রাচীনকালে যে পরিচয় ছিল, সর্বত্র যে কারণে সমাদৃত হতেন, সেই সমাদর কি নষ্টের পথে?


সাম্প্রতিক করোনা কি শিক্ষার বৈষম্যকে আরো বিস্তৃত করেছে?

(শেষটুকু পরবর্তী পর্বে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ