শুদ্রশিক্ষাঃ করোনাকালে অতীতমুখে (চতুর্থ ও শেষ পর্ব)

লিখেছেন রাণা হাজরা


আসনের উপরে বসে শিশু দুলেদুলে পড়ে চলেছে, মা রান্নাঘর থেকে কান খাড়া করে শুনছে। চুপ হলেই দূর থেকে ধমক। শিশু আবার দুলে দুলে গলা তুলে ছন্দে ছন্দে মুখস্ত করা শুরু করে।

২৪ মার্চ' ২০২০তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন লকডাউনের ঘোষণা করলেন, তখন প্রথম যে দুশ্চিন্তা মানুষকে গ্রাস করেছিল তা রোজগার ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের চাহিদা মেটানো। যার রেশ এখনো মিলে যায়নি। বরং তা ক্রমবর্দ্ধমান বলে বোধ হয়। সংবাদমাধ্যমের পাতায় জায়গা করে নেয় অভাবী সংসারে সবাইকে হত্যা করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া মানুষটি। এই সমস্যা আমাদের চোখের সামনে নিরন্তর ঘটে চলেছে। কিন্তু যেটা অনুভব দিয়ে বুঝতে হবে, তা শিশুশিক্ষায় নিদারুন অবহেলা ও এক প্রজন্ম দুটো বছর সম্পূর্ণভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকা।

শিশুরা দামী স্মার্টফোন টেবিলের উপরে রেখে চেয়ারে বসে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং লকডাউন পর্যায়ে মা-বাবা প্রসন্নচিত্তে লক্ষ্য করে চলেছে, এটাই এখনো স্বাভাবিক দৃশ্য। 
যদিও তা স্বাভাবিক ওই দশ শতাংশের মত উচ্চবর্ণীয়দের কাছে। ভারতের মধ্যেও যে বিপুল ভারতীয়ের বাস, যাদের দুবেলা অন্ন জোটানো দুষ্কর, যাদের শিশুরা সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে একবেলার খাবারের উপরে নির্ভরশীল, সেই শিশুরা কিভাবে স্মার্টফোন পাবে? তাদের বাবা-মায়েরা কিভাবে স্মার্টফোন জোগাড় করে দেবে, কেউ কি কখনো ভেবেছেন?

২০২০ সাল নাগাদ ভারতের প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করত বলে অনুমান, যা প্রায় ৭৫ কোটির কাছাকাছি। (তথ্যসূত্রঃ স্ট্যাসিটা ডট কম)
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে প্রায় ২৫ কোটি পরিবার বাস করে। প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে পাটিগণিতের সহজ নিয়মে প্রতি পরিবারে ৫-৬ জনের বাস। মধ্যবিত্ত, ধনী ও অতিধনী পরিবারের প্রত্যেকের কাছেই স্মার্টফোন আছে ধরে নিলে এবং পরিবারের অনেকের কাছে একের অধিক স্মার্টফোন আছে ধরে নিলে প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবার স্মার্টফোন বিহীন বলে ধরে নিতে হবে। 
২০১৪ সালের রঙ্গরাজন কমিটির হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৪৫ কোটি ভারতীয় দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করত, শতাংশের হিসেবে প্রায় ৩৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ এ প্রায় আট কোটি ভারতীয় অতি দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করত বলে অনুমান, যাদের দৈনিক রোজগার ১০০ টাকার কম। করোনাকালে এই সংখ্যা প্রায় ২-৫ গুণ বাড়তে পারে বলে অনুমান। অতএব যাদের মাসিক রোজগার তিন হাজার থেকে পাচ হাজারের মধ্যে তারা কিভাবে আট-দশ হাজারের মোবাইল কিনে শিশুর হাতে তুলে দেবে?
বরং যখন রোজগার দায় হয়ে পড়েছে, তখন শিশুশ্রম তীব্রভাবে বেড়েছে বলে অভিমত।

ভারতের অন্তত অর্ধেক শিশু দুটো বছর সম্পূর্ণভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল। যার পরিণাম ভবিষ্যতে ভয়াবহ রূপে দেখা দেবে। যে সরকার মনুভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে চায়, সেখানে উচ্চবর্ণীয়রা শিক্ষালাভ করবে, আর নিম্নবর্ণীয় শিশুরা কচি হাতে ইটভাটায় কাজ করে বাবুদের প্রাসাদ গড়বে, কিশোরী মেয়েটি বাবুবাড়িতে সেবা করবে; এটাই বর্ণাশ্রম। যা রাজার চাহিদা, তাই ভারতে পূর্ণ হবে। সর্বশিক্ষা অভিযান শুধু খাতায় কলমে থেকে যাবে। 

করোনা কালের ভারতে শুধু আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়নি, সামাজিক বৈষম্য অতি দ্রুত বেড়ে চলেছে ও চলবে। 
করোনাকালে শুদ্রদের মাথা উচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বোধ হয় ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ