এখন সাতসকালেই বাড়ি ফিরে যেতেও কেমন লাগে। অগত্যা, কিছুক্ষণ সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে গেলাম। টুকটাক কিছু কাজও ছিল। আমার অফিস যেখানে অর্থাৎ বড়বাজার-টিবোর্ড এলাকা, সেটা কলকাতার অন্যতম জনাকীর্ণ অঞ্চল। রাস্তার দু'ধারে সারি সারি দোকান। প্রতিষ্ঠিত দোকান বা শপিং কমপ্লেক্স ছাড়াও ফুটপাত দখল করে এমনকি রাস্তার উপরও লোকেরা বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। ঘিঞ্জি এলাকা, ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই চলাফেরার বিশেষ কোন জায়গা নেই। অফিস যাতায়াত করতে পথচারীদের প্রায় সবসময়ই রাস্তার মাঝখান দিয়ে গাড়ি-ঘোড়ার সাথে রাস্তা ভাগাভাগি করে নিতে হয়।
মন্দির, মসজিদ, গির্জা সবকিছুই গায়ে গায়ে গড়ে উঠেছে। তাতে 'ভগবান'দের বিশেষ সমস্যা আছে বলে মনে হয়না। এমনকি তাদের ভক্তদেরও বিশেষ কোন সমস্যা চোখে পড়ছেনা। কারণ এখানকার অধিকাংশ মানুষই নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী। পেটের খিদে হয়তো তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ করা বড়লোকদের বিলাসিতা মাত্র। মসজিদের উল্টো দিকে একটা মার্কেটিং বিল্ডিং আছে, তার নাম 'রাম রহিম মার্কেট'। বোঝা যায় অঞ্চলটা এখনও আমাদের ভারত-ই আছে। বিজেপির 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান' এখনো একে গ্রাস করতে পারেনি।
মসজিদের পাশের গলিতে একটু দূরে দূরে মোবাইল রিপেয়ারিংয়ের দোকান। মোবাইলের পাওয়ার বাটনটায় কিছু সমস্যা হচ্ছিল। একটা দোকানে গিয়ে মোবাইলটা দিলাম। সে দেখেশুনে বলল হয়ে যাবে, আড়াইশো টাকা লাগবে। সারাই করতে দিয়ে এদিক-সেদিক দেখছিলাম। বেলা বারোটা বেজে গেছে। একটা ছেলে তাকে নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য ডাক দিল। "তুম যাও, ম্যায় দাদা কা কাম করকে আতা হুঁ।"
অভিজ্ঞতাই হয়তো তাকে শিখিয়ে দিয়েছে আল্লাহ তারজন্য অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু যেখানে দু'হাতের দুরত্বে অন্য দোকানদার আছে সেখানে কাস্টমার অপেক্ষা করবেনা।
মোবাইল সারিয়ে মসজিদের পাশের গলি ধরে এগোতে থাকলাম। ক্রিসমাস এসে গেছে। ফলে বাজারেও তার প্রভাব পড়েছে। দোকানে দোকানে স্যান্টার টুপি, পুতুল, ক্রিসমাস ট্রি, কেক, আলো ঢেলে বিক্রি হচ্ছে। লোকে কিনছেও। বোঝা যাচ্ছে লোকে করোনা আতঙ্কে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই এইসব উৎসবের ভিতরই বেঁচে থাকার রসদ খুঁজছে। 'বেঁচে থাকার রসদ' কথাটা উভয় দিক থেকেই সত্য। করোনার আতঙ্কে সাধারণ ব্যবসায়ীরা যে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছেন সেটা গোমূত্রপায়ী দ্বিপদছাড়া কারো অজানা থাকার কথা নয়। মসজিদের পাশের গলি, স্বাভাবিক ভাবেই বিক্রেতাদের অনেকেই মুসলিম। মাথায় টুপি, লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ব্যবসায়ী সাদা দাড়িওয়ালা স্যান্টাক্লজ সাজিয়ে বসে আছে দেখতে মন্দ লাগছেনা। এই ব্যবসায়ী যদি মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে প্রচার করতে বেরতেন যে ১০৯৫ থেকে ১২৯১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর খৃষ্টান আর মুসলমানদের মধ্যে ইউরোপে আটবার রক্তক্ষয়ী ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড হয়েছিল, তাহলে কি তার পেট চলত?
সেসব রাজারাজড়ারা তো নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধ করে ইতিহাস হয়ে গেছেন। তাদের ইতিহাস থেকে টেনে বের করে এনে আজকের সমাজে চালানোর ভুল করলে নিজেদেরই অস্তিত্ব বিনাশ করে ইতিহাস হয়ে যেতে হবে।
অবশ্য এটা বড়বাজার এলাকা। এখানে জয় মাতাদি লেখা লাল কাপড় থেকে ইসলামিক চাঁদ-তারা চিহ্নযুক্ত সবুজ কাপড় সবই পাশাপাশি বিক্রি হয়।
একটু ফাঁকা পেয়ে স্যান্টা টুপি কেনার অছিলায় এক চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপ ইয়ে সব বেচ রহে হো?"
অভিজ্ঞ বৃদ্ধ ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বললেন, "রব তো এক হি হ্যায় বেটা। অউর পেট সে বড়া কোই মজহব নেহি হোতা।"
বুঝলাম, দাড়িটা তার এমনিই সাদা হয়নি। উনি জীবনের সার সত্য বুঝে গেছেন, পেটের ক্ষুধার চেয়ে বড় কোন ধর্ম হয়না।
2 মন্তব্যসমূহ
জীবনের সহজ সত্য এটাই,ভরসাও।
উত্তরমুছুনসত্যিই, "...পেট সে বড়া কোই মজহব নেহি হোতা।"
উত্তরমুছুন