বাঙালিয়ানা - মণীশ রায়চৌধুরী

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা


দেখুন মশাই, হয় আপনি বাঙালি নাহলে আপনি বিজেপি।

দুটো একসাথে হওয়া সম্ভব নয়।

আর যদি আপনি একসাথে দুটো হওয়া নিয়েই গর্ববোধ করেন তাহলে আপনি 'ভন্ড দ্য গ্রেট'।

কী হল? 

আমার কথাটা পছন্দ হলনা বুঝি?

আচ্ছা চলুন একটু বিচার বিবেচনা করা যাক।

মশাই, বিজেপি কী জন্য বিখ্যাত বলুন তো?

ওরা উগ্র হিন্দুত্ববাদ, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের প্রচারের জন্য পরিচিত। 

বাঙালির ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি কিছুই ওদের সাথে মেলেনা।

হানাহানি, ধর্মীয় গোঁড়ামির অপসংস্কৃতি বাঙালির জন্য নয়।


তারমানে বাঙালির সবাই কি ধর্ম মানেনা, নাস্তিক? 

মোটেই না, এমন ঘটা করে দুর্গাপুজো কোথায় হয় মশাই?

আবার মানবিক গুণসম্পন্ন নাস্তিককেও বাঙালি মাথায় করে রেখেছে বিদ্যাসাগর তার সর্বোত্তম উদাহরণ। 

আসলে বাঙালির মনন চৈতন্য, লালনের ভাবধারায় পুষ্ট।


গোবলয়ের হিন্দুর সাথে বাঙালি হিন্দুর মূল পার্থক্য হল তাদের দেবতা প্রচন্ড, অর্ঘ্য না দিলে তিনি কঠোর শাস্তি দেন আর বাঙালি নিজেদের দেবদেবীদের ভালবাসে, আপন ভাবে তাই ভয় পায়না বরং আপনজনের মত তাদেরই সুখ দুঃখের সাথী করে নেয়।

তাই দশপ্রহরণধারিনী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গাকে তারা ঘরের মেয়ে উমা বানিয়ে ছাড়ে যে নাকি চারদিনের জন্য বাপের বাড়ি আসে।

তাই তো বাঙালি গান লিখতে পারে, "যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী... "।

এখানেই শেষ নয় বাঙালি তার আরাধ্যকে নিয়ে মজা করতে পারে এটা তার এক বিরল গুণ।

তাই তো সে অক্লেশে প্রশ্ন করতে পারে, " এত গয়না বেটি কোথায় পেলি?"

কারণ, তার স্বামী যে ভিখারি মহাদেব। 

মহাদেবের গাঁজা খাওয়া নিয়ে যে বাঙালি কত ছড়া, কত রম্যরচনা লিখেছে তা বলে শেষ করা যাবেনা। 

একমাত্র বাঙালিই হয়তো ছড়া কাটতে পারে "গণেশদাদা পেটটি নাদা"।

আগেই বলেছি দেবতা বাঙালির কাছে আপনজন।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, "দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা"।


শুধু তাই নয়।

কিছুক্ষেত্রে বাংলাসাহিত্যতে মানুষ দেবতার প্রতিষ্পর্ধী হয়ে উঠেছে। 

মনসামঙ্গল কাব্যে যখন মনসা সাধারণ মানুষ চাঁদ সওদাগরের উল্টোমুখে বসে বাঁহাতে অভক্তি ভরে ছোঁড়া ফুল নিয়েই সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হন তখন তা মানবতার, অখন্ড পৌরুষেরই জয় ঘোষণা করে।

বাঙালি কিন্তু সে সাহিত্য হিন্দু ধর্ম বিরোধী বলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি বরং তাকে ধর্মপালনের ব্রতকথার অংশ করে নিয়েছে। 

এরসাথে বিজেপির হিন্দুধর্মে আঘাতের নামে ফতোয়া দেওয়া এমনকি বিরোধী কে হত্যা করে ফেলার গুন্ডামির মিল কোথায়?


বিজেপির কথা যখন উঠলো তখন রামের কথা আর বাদ যায় কী করে?

কিন্তু গোবলয়ের 'জ্যায় শ্রীরাম' আর বাঙালির রাম কিন্তু এক নয়।

বাঙালি রাম কে মূলত দুভাবে চেনে।

উচ্চশিক্ষিত বাঙালি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের রামকে চেনে।

ভাবা যায়, ১৮৬১ সালে মাইকেল রাবণকে হিরো আর রামকে নেগেটিভ চরিত্র দেখিয়ে এই অমোঘ সাহিত্য রচনা করেছিলেন!!! 

তিনিই নায়ক মেঘনাদের মুখ দিয়ে বলাতে পেরেছিলেন, " কে বা সে অধম রাম?"

শিক্ষিত বাঙালি কিন্তু রে রে করে তার মুন্ডুপাত করতে যায়নি বরং সাহিত্যসভা করে তাকে সম্বর্ধনা  জানিয়েছে। আজকের স্মার্টফোনধারী আধুনিক বাঙালি হলে হয়তো ত্রিশূল নিয়ে তাড়া করত।

আর সাধারণ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বাঙালি কবি কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়েই রামকে চিনেছে।

বিজেপির রাম বেদপাঠ করার জন্য শম্বুক কে হত্যা করে। যুগ পাল্টালেও রোহিত ভেমুলাদের মৃত্যুর মাধ্যমে শম্বুক হত্যার ধারা এখনও চলছে।

কিন্তু কৃত্তিবাসী রাম ভক্তবৎসল। 

সেখানে রাবণ সারা গায়ে রামনাম লিখে যুদ্ধে আসে যাতে রামের হাতে মরে মুক্তিলাভ করতে পারে। আর রামচন্দ্র তা দেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে,  "এমন ভক্তেরে হায় কি করে করিব সংহার

জগতে রামনাম কেহ আর লইবে কি আর?"

হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের 'জ্যায় শ্রীরাম' বলে নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করার বর্বর ধর্মপ্রচারের সাথে এই রামের কি আদৌ কোন মিল আছে?

তাই তো বলছি আজ আমাদেরই ঠিক করতে হবে আমরা বাঙালিই থাকব নাহি বিজেপি হয়ে যাব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ