সরকারি টাকা

 

লিখেছেন মণীশ রায়চৌধুরী

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, "ভাগের মা গঙ্গা পায়না"।

অর্থাৎ, যে বস্তু বা ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট মালিকানা বা দায়ভার নেই তার সদগতি হয়না।

আমাদের দেশে সরকারি টাকা প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। 

সরকারি টাকার মালিক যে জনগণ এবং ক্ষমতাসীন নেতা-নেত্রীরা যে জনতারই সেবক মাত্র সেসব কথা আজকাল তত্ত্বকথা'র বইতেই শুধু পাওয়া যায়। 


প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী কোন একটা অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়ে অবসর সময়ে তার স্ত্রীর জন্য শাড়ি কিনতে গেছিলেন। 

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দোকানে এসেছেন। স্বাভাবিকভাবেই দোকানদার স্ত্রীর জন্য দামি শাড়ি উপহার হিসেবে বের করেছেন। শাড়িটি শাস্ত্রীজি'র খুবই পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু দাম শুনে তিনি বিনয়ের সাথে জানিয়েছিলেন এত দামি শাড়ি কিনে দেওয়ার সামর্থ্য তার নেই। 

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কাজের সুবিধার জন্য ৫০০০/- ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে তিনি একটি মোটরগাড়ি কিনেছিলেন। তার মৃত্যুর পরে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক তার স্ত্রীর কাছে নোটিশ পাঠিয়েছিল। তার স্ত্রী নিজের প্রাপ্য পেনশন থেকে ধীরে ধীরে সেই ঋণ পরিশোধ করেন। 

ব্যক্তিগত সততার এসব উদাহরণ দিলে লোকে আজকাল পাগল বলবে। 


সেইজন্যই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজের সাংবিধানিক দায়দায়িত্ব ভুলে মেরে দিয়ে বিজেপির প্রচারক হয়ে রাজ্যে রাজ্যে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। 

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে তার বিদেশ যাত্রা বন্ধ আছে, নাহলে তো তিনি দেশে থাকলেই সেটা 'ব্রেকিং নিউজ' হত।

কিন্তু তিনি তো আর আম আদমি নন। তিনি কোথাও গেলেই মন্ত্রীসান্ত্রী, পাইক-বরকন্দাজরাও সাথে যায়। ২০২০ সালে রাজ্যসভায় এক প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকে জানা যায় ২০১৫ থেকে মোদি মোট ৫৮ টি দেশে বিদেশভ্রমণ করেছেন যার মোট খরচ ৫১৭.৮২ কোটি টাকা। তিনি দেশের সবচেয়ে দামি 'ফকির'। এমন ফকিরের ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য যে স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ বা এসপিজি থাকে গত আর্থিক বর্ষে কেন্দ্রসরকার তারজন্য ৫৯২ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিদিনের সুরক্ষার জন্য আনুমানিক ১.৬২ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এটা শুধুমাত্রই তার অঙ্গ সুরক্ষার খরচ। এরসাথে প্রধানমন্ত্রী কোথাও গেলে তার যাতায়াত, থাকা-খাওয়া সবকিছুর আনুসঙ্গিক খরচ তো বাদই দিলাম। 

এই টাকা কার?

কেন, সরকারি টাকা। 

অতএব কে, কার টাকার হিসাব রাখে?

তাই প্রধানমন্ত্রী এক-একটা রাজ্যে ভোট চাইতে একবারের জায়গায় দশবার যেতেই পারেন। 

কার ঘাড়ে ক'টা মাথা যে তার কাছে এই ব্যয়ের জবাবদিহি করবে?


কথায় বলে মাছের মাথায় আগে পচন ধরে। 

তাই প্রধানমন্ত্রীকেই আলোচনায় তুলে ধরলাম।

কিন্তু, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে কুঁচো এমএলএ এমনকি পাড়ার কাউন্সিলর পর্যন্ত সরকারি টাকাকে নিজের বাপের টাকা মনে করেই ইচ্ছামত ব্যয় করে থাকে। 

আমরাও এসব দেখতে দেখতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে এই অপচয়গুলি আমাদের চোখে ধরাই পড়েনা।


সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে সরকারি টাকা নষ্টের একটা উদাহরণ তুলে ধরা যাক।

এবারের নির্বাচনে বিজেপির ৫ জন সাংসদ 'দলীয় নির্দেশে' বিধায়ক পদে প্রতিদ্বন্দিতা করলেন। 

নিশীথ প্রামাণিক এবং জগন্নাথ সরকার ব্যতীত বাকি তিনজন পরাজিত হলেন।

নিয়মানুসারে একই ব্যক্তি সাংসদ অথবা বিধায়ক দুটি পদের যেকোন একটি পদেই থাকতে পারবেন। নিশীথ এবং জগন্নাথ বাবুও জানালেন তারা দলের অনুগত সৈনিক, দলের নির্দেশে লড়েছিলেন এবং দলের নির্দেশে তারা সাংসদই থাকবেন। তারা জিতেও বিধায়ক পদে ইস্তফা দিলেন। ফলে, দুটি আসনে উপনির্বাচন করতে হবে। তারমানে সরকারি টাকা খরচ হবে। যদি তারা বিধায়ক পদে শপথ নিতেন তাহলেও দুটো সাংসদ পদের জন্য উপনির্বাচন করতে হত। সেখানেও সরকারি টাকা খরচ হত। দুটো পদে একসাথে দাঁড়ালে একটা উপনির্বাচন হবেই জেনেও ভোটে দাঁড়ানোর একটাই অর্থ হয় সরকারি টাকা নষ্ট হওয়া এদের কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই নয়।


গল্পটা এখানেই শেষ নয়।

প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ছেড়ে যাওয়া ভবানীপুর আসনে 'দলীয় নির্দেশে' প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জিতে মন্ত্রী হলেন।

এদিকে ঘটনাচক্রে তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল জনাদেশে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এলেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে নন্দীগ্রাম কেন্দ্র থেকে পরাজিত হয়েছেন। এখন নিয়মানুসারে তাকে ছ'মাসের ভিতর উপনির্বাচনে জিততে হবে। তাতে কোন অসুবিধাও ছিলনা। কারণ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে প্রার্থীদের করোনায় মৃত্যু হওয়ার ফলে সেইসব কেন্দ্রগুলিতে এমনিতেই উপনির্বাচন হবে। মুখ্যমন্ত্রী চাইলেই তার ভিতর যেকোন একটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। ভোটে হারার পরেও তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার বিশ্বাস দেখিয়েছেন, তখন সন্দেহাতীতভাবে রাজ্যের সবচেয়ে হেভিওয়েট প্রার্থী হয়ে একটা সামান্য উপনির্বাচন তিনি যেকোন কেন্দ্র থেকে জিততে পারবেন এটুকু আত্মবিশ্বাস তার থাকা উচিত ছিল বলেই মনে করি। কিন্তু, তিনি নিজের বরাবরের 'সেফ সিট' ভবানীপুর থেকেই ভোটে দাঁড়াবেন মনস্থির করলেন। ফলে দলের অনুগত সৈনিক শোভনদেব 'দলীয় নির্দেশে' পদত্যাগ করলেন। কিন্তু, তিনি এটা জানাতেও ভোলেননি যে তিনি মন্ত্রীপদে নিজের দায়িত্ব পালন করে যেতে ইচ্ছুক। তাহলে হিসেবটা কী দাঁড়ালো? 

মন্ত্রীত্ব বজায় রাখতে তাকেও ছয়মাসের ভিতর একটা উপনির্বাচনে জিততে হবে। সোজা ভাষায় একটা অতিরিক্ত উপনির্বাচন হতে চলেছে। 

তারপরই আমাদের সামনে উপস্থিত হল কলকাতা পুর-ভোট। সেখানেও আমরা একই চিত্র দেখলাম। শাসক দল তৃণমূলের ৬ জন এমএলএ এমনকি একজন এমপি পর্যন্ত 'মানুষের জন্য কাজ করার তাগিদে' কাউন্সিলর পদে আবার ভোটে দাঁড়ালেন এবং জিতলেনও। অতএব, আবার সেই 'অফিস অফ প্রফিট' ইস্যুতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। এসব 'গুরুত্বহীন' খবর কাগজে আসবেওনা, তাই আমাদের ভাবনাতেও দাগ কাটবেনা।


এইযে এতসব নির্বাচন হবে সে টাকা আসবে কোথা থেকে? 

উত্তর, সেই সরকারি টাকা। 

কিন্তু, এই টাকা তো আকাশ থেকে পড়ছেনা।

এগুলো আমাদেরই ট্যাক্সের টাকা যা বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা ব্যক্তিগত তথা দলীয় স্বার্থে ইচ্ছাকৃতভাবে অপচয় করছেন। 

আর আমরাও এইসব অপচয় দেখতে দেখতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে প্রশ্ন করতেও ভুলে গেছি। 

তাই নেতারাও বুঝে গেছে, "পাবলিক কা মাল দরিয়া মে ডাল"।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ