লিখেছেন মণীশ রায়চৌধুরী
অত্যন্ত লজ্জার বিষয় যে আমার মাতৃভূমি ভারত আজ প্রশ্ন কে ভয় পাচ্ছে।
যারাই সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন, যারাই নিজের মগজটা কে সরকারের পায়ে বন্ধক রাখছেননা, যারাই ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনা করছেন তাদের আক্রান্ত হতে হচ্ছে।
মিথ্যা প্রচারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সরকার আর দেশকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সরকারের দুর্নীতির বিরোধিতা কে দেশের বিরোধিতা বলে দেশদ্রোহিতা বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে।
আর কাউকে একবার দেশদ্রোহী তকমা দিতে পারলে তাকে গণধোলাইয়ে মেরে দেওয়াটাও আমাদের "পবিত্র জাতীয় কর্তব্য" হয়ে দাঁড়ায়।
দেশ, দেশপ্রেম, দেশদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রতিটা শব্দকে গোয়েবলীয় মিথ্যাচার করে কী সুন্দর ভুল বোঝান হচ্ছে।
বারবার বলে আমাদের মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই সকল ব্যতিক্রমী মানুষেরা ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী, তারা চীন বা পাকিস্তানের দালাল মোদ্দা কথায় দেশদ্রোহী।
আচ্ছা, কাকে বলে ভারতীয় সংস্কৃতি?
বিজেপি এবং বজরং দলের লোকেরা যেটাকে ভারতীয়ত্ব বলে প্রচার করছেন আদপে সেটাই কি এই সুমহান ঐতিহ্যবাহী দেশের প্রকৃত আদর্শ বা নীতি ছিল?
বিনা প্রশ্নে সবকিছু মেনে নেওয়া "হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান" ছাঁচে ফেলা দেশ কোনদিনই আমাদের সেই মহান ভারত নয়।
ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে এই দেশের মূল ঐতিহ্য হল পরমতসহনশীল বহুত্ববাদী সংস্কৃতি।
প্রাচীন কাল থেকেই এদেশে অধ্যাত্মবাদী বিভিন্ন চিন্তাভাবনা ছিল, তাদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হত।
সেই চিন্তার বহু প্রকাশ আমরা বেদ, উপনিষদ এবং ধর্মশাস্ত্রর বিভিন্ন অংশে পাই।
কিন্তু শুধুই তা নয়।
এদেশ একইসাথে ছিল ঘোরতর অজ্ঞেয়বাদী, নাস্তিক্যবাদী।
বিনা প্রশ্নে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মেনে নিতেও এই দেশ শেখায়না।
এই দেশ প্রশ্ন করতে শেখায়, নানাভাবে যাচাই করে তবেই মেনে নিতে শেখায়।
ভারতের প্রাচীনতম দর্শন মীমাংসা।
সেই মীমাংসা দর্শন প্রশ্ন করেছিল-
ঈশ্বর কেন এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন?
যখন বিশ্ব ছিলনা তখন স্থান, কাল, সময় কিছুই ছিলনা।
তাহলে ঈশ্বর কোন স্থানে দাঁড়িয়ে কোন সময়ে বিশ্ব সৃষ্টি করলেন?
আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষিতদের মাথা হেঁট করে দেওয়া এমনই কত প্রশ্ন মীমাংসা তুলে ধরেছিল।
এছাড়াও ছিল চার্বাক তথা আরো অনেক বস্তুবাদী দর্শন।
আরে এটাই তো সেই ভারত, যার আদিমতম শিক্ষাবিদ গৌতম বুদ্ধ তার শিষ্যদের শিখিয়ে ছিলেন, "আমি বলছি বলেই কোন কিছু মেনে নিয়োনা, কোন কিছুকেই যাচাই না করে স্বতঃপ্রমাণিত বলে মনে করবেনা।"
কী বলবেন একে, পাকিস্তানের চর না চীনের দালাল?
বুদ্ধের শিক্ষা, নালন্দার জ্ঞান বিজ্ঞানের শিক্ষা, বিভিন্নধরনের বিরুদ্ধ মতের ভিতর সুস্থ বিতর্কের শিক্ষা কি তবে যথেষ্ট ভারতীয় নয়?
আধুনিক তথাকথিত দেশপ্রেমিকগণ কী বলেন?
আচ্ছা, আজ যারা শাসকের বিরোধিতা করার জন্য দেশদ্রোহী তকমা দিচ্ছেন তারা কি ভারতের প্রাচীনতম শিক্ষামূলক গ্রন্থ পঞ্চতন্ত্রর নাম শুনেছেন?
তারা কি আদৌ জানেন ভারত কে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া পঞ্চতন্ত্রের গল্পে উল্লেখিত সঞ্জীবক নামক সেই বিদ্রোহী ষাঁড়ের কথা, যে নানা মানসিক টানাপোড়েনের পর অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রজা কে যদি অত্যাচারী রাজা সিংহের হাতে মরতেই হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, যুদ্ধ করেই মরা উচিত???
নব্য দেশপ্রেমিকরা কি কোন এক রবিঠাকুরের নাম শুনেছেন যিনি পরিণত বয়সে এসে বলে গেছিলেন তথাকথিত জাতীয়তাবাদের থেকে মানবতার দাবি অনেক বড় এবং তিনি কোন মূল্যেই হীরে ফেলে কাচের টুকরো নেবেননা।
শুধু তাই নয়, এই দাড়ি ওয়ালা লোকটাই (দাড়ি আছে যখন তখন নির্ঘাৎ পাকিস্তানি) বলে গেছিল দেশ কে দেশ বলেই শ্রদ্ধা করা উচিত, দেশের মানুষের সেবা করা উচিত।
যারা মন্ত্রের মত দেশকে মা বলে চিৎকার করে তাদের ভক্তিটা দেশের প্রতি নয়, সেটা কোন এক অন্ধ মোহের প্রতি যা দেশকে সর্বনাশের পথে নিয়ে চলে।
দেশ মানে দেশের মাটি নয়, দেশের মানুষ।
তাই দেশের মানুষই অসুখী হলে বন্দেমাতরম ধ্বনির কাব্যকথায় দেশের লজ্জা ঘুচবেনা এটাও ঐ লোকটারই কথা।
যেসকল নব্য দেশপ্রেমিক কথায় কথায় রবিঠাকুর কে নিজের আদর্শ বলেন তারা এগুলো জানেন কি?
না, জানেননা।
আর সেই জন্যই তারা সকল বিরোধী স্বর কে থামিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোন এক কাল্পনিক ভারতীয়ত্ব তথা জাতীয়তাবাদ কে খুঁজে পাচ্ছেন।
আমি গর্বিত, আমি সেই ভারতে জন্মেছি যেখানে প্রশ্ন করতে শেখানো হত।
আমি লজ্জিত আমি সেই ভারতে বাস করি যেখানে প্রশ্ন করা প্রতিটি বিরোধী স্বর কে ভারতীয়ত্বর নামেই চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।
0 মন্তব্যসমূহ