মাতৃভক্তি: গোমাতা থেকে দেশমাতা


দেখুন মশাই শাস্ত্রে বলেছে অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। 

আমাদের এখন এই ভক্তিযোগ চলছে।

এই দেখুন না, আমরা মাকে কত্তো ভালবাসি।

আর আমাদের মা কি শুধু একটা নাকি?

দুর্গা, কালী, সন্তোষী ইত্যাদি সব অলৌকিক মাতাদের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। 

এছাড়াও ভারতমাতা, গোমাতা কত কী আছে আমাদের। 


আরে মশাই, জানেন না আমরা নারী কে দেবীজ্ঞানে, মাতৃজ্ঞানে পুজো করি।

হুঁ হুঁ, ওসব সাহেবসুবোরা কি আর আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বুঝবে? 

এই যে অতিভক্তি এখানেই যত ভন্ডামি শুরু হয়।

তাই তো আমাদের নিজের মা বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই পান।

নারীর সম্মানের কথা আর নাহয় নাই বা বললাম। 

দুমাসের শিশু থেকে পঁচাত্তরের বৃদ্ধা কেউই এদেশে সুরক্ষিত নন।

দুমাসের শিশুর যোনিকে যৌনাঙ্গ বলব না রেচনাঙ্গ বলব আমি জানিনা।

কিন্তু দৈনিক সংবাদপত্র দৈনিক, প্রতিদিন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সারাক্ষণ নারীর মর্যাদা নিয়ে ঐতিহ্যের দোহাই দেওয়া উত্থিত শিশ্নের (এদের পুরুষ বা মানুষ না বলে শিশ্ন বলাটাই হয়ত ভাল, এদের একটাই অঙ্গ কাজ করে) হাতে সে সুরক্ষিত নয়।


আরেক মাতা হলেন গোমাতা।

ইনি কিন্তু যে সে মাতা নন, স্বয়ং রাজমাতা।

বর্তমানে দেশে মানুষের তুলনায় এদের কদর সহস্র গুণ। এদের রক্ষার নামে তার দুপেয়ে বাছুরেরা মানুষকেই হত্যা করতে দুবার ভাবছেনা।

কিন্তু বাস্তবে এদের অবস্থা কী?

মাত্র কয়েক মাস আগের সংবাদপত্রেই অনাহারে অসংখ্য গরুর করুণ মৃত্যুর খবর আছে।

বিদেশে গরুকে গরু মানে একটা উপকারী প্রাণী ভাবা হয় তাই তার যত্নের কোন অভাব হয়না।

Bovine Culture বা গো-পালনবিদ্যা তো রীতিমত পড়ানো হয়।

অবশ্য যে দেশে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হয় সেখানে গোমাতা শুধু নামেই মাতা যাকে শুধু ভোটব্যাংক বাড়াতে ব্যবহার করা হয়।


এই দেখুন আরেক মাতার কথা তো ভুলেই গেছি।

'হর হর গঙ্গে', 'জয় গঙ্গা মাইয়া'

আরে এই এক স্লোগান দিয়ে লোকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে আর আমি কিনা এটাই ভুলে গেছি।

ভারতীয় জনজীবনে গঙ্গার অবদান কী তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই।

কিন্তু এত দিয়ে গঙ্গার প্রাপ্তি কোটি কোটি কলিফর্ম এবং নানা ফর্মের ব্যাকটেরিয়া!!!

যে বিজেপি সরকার কথায় কথায় ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দেয় তারা গঙ্গা কে দূষণমুক্ত করতে কী করেছে? 

'নমামি গঙ্গে' প্রোজেক্টের কোটি কোটি টাকা কোথায় গেল?

এখানেও সেই একই কথা প্রযোজ্য।

ইংরেজরা টেমস কে তাদের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নদী, হ্যাঁ শুধুই নদী ভাবে তাই তাকে দূষণমুক্ত রাখে।

আমাদের মত চিৎকার করে মা বলব আর প্রোজেক্টের টাকা মারব এটা ওরা শেখেনি।


সবশেষে ভারতমাতার কথায় আসা যাক।

ওরে বাবা, কিছু বলতেই তো ভয় লাগছে।

আজকাল চারদিকে দেশভক্ত গিজগিজ করছে। 

কে কখন দেশদ্রোহী বলে মুন্ডু কেটে নেয় ঠিক নেই। বিশেষত আজকাল এসব করলে সাংসদ হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

মজার কথা, এইসব দেশপ্রেমিকদের কল্যাণে বিশ্বে ভারত আজ এক পিছিয়ে পড়া দেশ হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে।

Global Hunger Index, Happiness Index, Transparency International Report,  Press Freedom Index এরকম যত আন্তর্জাতিক রিপোর্ট আছে সবেতেই ভারতের পিছিয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে।


এর কারণ কী?

কারণ যে বা যারা গলার শিরা ফুলিয়ে ভারতমাতার জয়গান করছে তারাই ততবেশি দুর্নীতি করে দেশকে সবদিক থেকে আরও আরও পিছিয়ে দিচ্ছে।

ভারতমাতা তাদের কাছে ক্ষমতা দখলের একটা হাতিয়ার মাত্র।

ওরা বুঝে গেছে এদেশে ভেক না ধরলে ভিখ মেলেনা। 


এই কথাগুলো বুঝেছিলেন বলেই তো রবীন্দ্রনাথ বারবার বুঝিয়ে ছিলেন দেশ মানে মাটি নয়, দেশের মানুষ। মানুষ অসুখী থাকলে বন্দেমাতরমের কাব্যকথায় দেশের লজ্জা ঘুচবেনা। 

তাই রবিঠাকুর বলতে পেরেছিলেন, দেশকে দেশ ভেবে যারা সেবা করতে পারেনা তারাই চিৎকার করে মা বলে, দেবী বলে তার পুজো করতে যায় এবং এই ভক্তি দেশের প্রতি নয় একটা মোহের প্রতি যা শুধু দেশের সর্বনাশই করতে পারে। 

অবশ্য বেঁচে থাকলে তিনিও হয়ত দেশদ্রোহী ঘোষিত হতেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ