৪ মার্চ, ২০২২ তারিখটা ক্রিকেটপ্রেমী মানুষরা চিরকাল চরম দুঃখের সাথে মনে রাখবে। সকালবেলা প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপার রডনি মার্শ মারা গেলেন। সমগ্র ক্রিকেটবিশ্বের সাথে টুইট করে শোকজ্ঞাপন করলেন অপর অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন। বিকেল গড়াতেই ক্রিকেটজগৎ আরেকটা দুঃসংবাদ শুনে শোকবিহ্বল হয়ে গেল। শেন ওয়ার্ন আর নেই। তাইল্যান্ডের একটা রিসোর্টে তাকে অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া যায়। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সচল করতে পারেনি।
সকালবেলা যে লোকটা অপর সতীর্থের মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করছে মাত্র কয়েকঘন্টার ভিতর সে নিজেই নেই হয়ে গেল।
সত্যি কী প্রচন্ড অনিশ্চিত এই জীবন। এই মুহুর্তেও যে লোকটা শ্বাস নিচ্ছে পরের মুহুর্তেই সেই লোকটা নাও থাকতে পারে। বিজ্ঞানের প্রচন্ড অগ্রগতির ফলে আমরা হয়তো অনেকটাই জীবনের রহস্যভেদ করতে পেরেছি। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এখনো অনেক রহস্যই আমাদের অধরা থেকে গেছে। যা হয়তো আমরা ভবিষ্যতে জানতে পারব।
মৃত্যু বিষয়ে আজকের দিনে দাঁড়িয়েও যদি আমাদের এত ধোঁয়াশা থাকে, তাহলে নিয়ান্ডারথাল বা অন্যান্য আদিম মানুষের পক্ষে তো জীবন-মৃত্যুর রহস্য বোঝা অসম্ভব ছিল। এই অজানা রহস্য, অজানা আতঙ্ক থেকেই ধীরে ধীরে অলৌকিকতা এবং ঈশ্বরের কল্পনা জন্মলাভ করে। তারা এমন এক উচ্চতর শক্তির কল্পনা করতে থাকে যা আমাদের জীবনচর্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই কল্পনাই পরবর্তীতে পুরোহিততন্ত্র এবং গোষ্ঠীপতি তথা রাজন্যবর্গের হাতে ফুলে ফেঁপে উঠে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের রূপ নিয়েছে।
অনেক মানুষ আমাকে বহুবার প্রশ্ন করেছে একজন যুক্তিবাদী হিসাবে জীবের মৃত্যু বিষয়টাকে আমি কিভাবে দেখি? তাই মৃত্যু বিষয়টাকে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে আমার মতো করে ব্যাখ্যা করলাম।
মানুষের মৃত্যু বিষয়ে সরাসরি না এসে আগে বস্তুবাদী দৃষ্টিতে জীবদেহ নিয়ে ভাবতে হবে।
যে কোন জীবদেহ অগণিত কোষ দিয়ে তৈরি।
মজার কথা আমরা যাকে আপাতদৃষ্টিতে জন্ম বা মৃত্যু বলে থাকি তখনই কিন্তু প্রতিটা কোষের জন্ম বা মৃত্যু হয়না।
প্রতিদিনই অগণিত কোষ জন্মায় ও মারা যায়।
এবার দেখা যাক এই চক্র কোথায় শুরু হচ্ছে।
উদাহরণ স্বরূপ যদি মানুষ কে বাছি তাহলে দেখব সঙ্গমকালে শুক্রাণু ডিম্বানুর ভিতর ঢুকে যায়।
এক্ষেত্রে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু একটা হ্যাপ্লয়েড কোষ আর তাদের মিলনে ডিপ্লয়েড জাইগোট তৈরি হয়।
এরপর কোষ বিভাজিত হয়ে ক্রমশ মরুলা, ব্লাস্টুলা এসব স্তর পেরিয়ে ভ্রুণ বিকাশ লাভ করে।
এখানে উল্লেখ্য যে উপযুক্ত পরিবেশে দেহের বাইরেও শুক্রাণু বা ডিম্বাণু বেঁচে থাকতে পারে। বর্তমানকালে তরল নাইট্রোজেনে সংরক্ষিত করে মানুষের শুক্রাণু, ডিম্বাণু রাখা হয়। যা পরবর্তীকালে প্রয়োজনমত গর্ভধারণ করতে কাজে লাগে। আবার প্রতিদিনই শরীরের অসংখ্য কোষ মারা যাচ্ছে।
তাহলে কি দেখছি?
প্রতিক্ষণেই অসংখ্য জন্ম বা মৃত্যু হচ্ছে।
এরমধ্যে আত্মা ঢোকা বা শরীর থেকে আত্মা বেরিয়ে যাওয়া হাস্যকর মিথ্যাচার।
তাহলে আমরা যেটাকে মৃত্যু বলি সেটা কি?
আসলে বিজ্ঞানের চোখে আমাদের এই শরীর অসংখ্য স্বতন্ত্র জীবনের এক অসাধারণ সমাহার মাত্র।
বিশেষ কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে তারা সামগ্রিক ভাবে উত্তেজনা তে সাড়া দেয় আবার একসময় তা থেমে যায়।
তাকে চলতি ভাষায় বলি মৃত্যু।
কিন্তু যেহেতু শরীর অসংখ্য জীবনের সমাহার তাই এই সামগ্রিক চেতনা লোপের পরেও অধিকাংশ কোষ বেঁচে থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বেঁচেও থাকতে পারে।
এজন্যই তো মৃত্যুর পর হার্ট, লিভার, চোখ আরও অনেক কিছু অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করা যায়।
আরও সোজা উদাহরণ দিচ্ছি।
রক্তদান করার পর বোতলে যে রক্ত থাকে সেটাকে কী বলবেন?
জীবিত না মৃত?
অবশ্যই জীবিত, তাইতো অন্যের শরীরে ঢুকলে কাজ শুরু করে দেয়।
শুধু প্রাণী কেন, উদ্ভিদের কথাও ভেবে দেখতে পারেন। মনে করুন একটা আমপাতার কিছু অংশ আপনি কাঁচি দিয়ে কেটে ফেললেন। দুয়েকদিনের ভিতরেই কিন্তু কাটা অংশটা শুকিয়ে যাবে। কিন্তু বাকি গাছ, এমনকি পাতার গাছের সাথে লেগে থাকা অংশটা কিন্তু জীবিতই থাকছে। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রের বিচার ধরলে পাতার কাটা টুকরোর আত্মাটা বেরিয়ে যাওয়া উচিত। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া সম্ভব যা থেকে দেহাতীত আত্মার ধর্মীয় তত্ত্বের অসারতাই প্রমাণ হয়।
যাকগে অনেক কথা বললাম।
সংক্ষেপে বলতে পারি, আমার মতে শরীর হল একটা সাইকেল বা হাতঘড়ির মত।
সেগুলো যেমন কোন আঘাতে খারাপ হয়ে যায় চলতে পারেনা কিন্তু তার স্প্রিং থেকে চাকা সব ব্যবহার করা যায়।
শরীরও তাই।
কোন রোগ বা আঘাত যেমন দুর্ঘটনায় শরীর মানে বেসিক স্ট্রাকচারের এমন ক্ষতি হল যে সেটা সারানো গেলনা।
তাকে বলি মারা গেল।
আসলে মারা যাওয়া মানে বিশেষ কিছু জৈবিক ও রাসায়নিক কারণে সামগ্রিক চেতনা লোপ পেল।
পার্টস খুলে অন্য স্ট্রাকচারে লাগালেই আবার চলবে।
আশা করি, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ খুব দ্রুত জীবন-মৃত্যুর রহস্য বুঝে ফেলতে সক্ষম হবে। তখন দুনিয়া থেকে যে অন্ধবিশ্বাসের চিরতরে মৃত্যু ঘটবে তার নাম হল ঈশ্বর।
0 মন্তব্যসমূহ