আমি মনে করিনা, এইমুহূর্তে বিজেপি কে পরাজিত করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কিছু হতে পারে।
এখনই তারা "ভারতমাতা" আর "বন্দেমাতরম" বাগাড়ম্বরের আড়ালে ভারতের দরিদ্র জনগণকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে।
আরও একবার বিজেপি ক্ষমতায় এলে নগ্ন ফ্যাসিবাদের যে চূড়ান্ত রূপ দেখতে হবে তা আমাদের কল্পনার অতীত।
পরাজিত মানে শুধু ভোটে হারানো নয়। কারণ বিজেপি এখন একটা বিষাক্ত চিন্তা-চেতনায় পরিণত হয়েছে যা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে।
তাই দেশকে বাঁচাতে তাদের ফ্যাসিস্ট চরিত্রটা জনতার সামনে তুলে ধরতে হবে।
এই কাজ করতে সংঘবদ্ধভাবে বাম শক্তিকে উঠে পড়ে লাগতে হবে। বামপন্থী দলগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা সবাই নিজেকে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বোদ্ধা মনে করে। একটা দলের ভিতরেই অসংখ্য গোষ্ঠী। আর এই পোড়া দেশে তো বামপন্থী দলই আছে একগাদা। কেউ কারো সাথে সহাবস্থানে রাজি নয়। ফলে বারো রাজপুত্তুরের তেরো হাঁড়ি হয়েছে। ভোটের আগে দু'মাস বক্তৃতা দেওয়ার পার্টটাইম রাজনীতি দিয়ে চলবেনা।
সুনির্দিষ্ট ইস্যুর ভিত্তিতে কংগ্রেসের সহায়তাও নিতে হবে। মনে রাখতে হবে সাম্প্রতিককালে চূড়ান্ত খারাপ ফলাফলের পরেও কংগ্রেসের একটা অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি আছে, ইতিহাস আছে। তাদের বাদ দিয়ে বিজেপি বিরোধী জোট গড়ার কথা যারা বলছে তারা জেনে বা না জেনে বিজেপিরই হাত শক্ত করছে। এর সাথে দক্ষিণ ভারতের বিজেপি রাজনৈতিক দলগুলোর (যেমন ডিএমকে) সাথেও ইস্যুভিত্তিক সমঝোতা করতে হবে। বিজেপির হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান নীতিকে দক্ষিণ ভারতের মানুষেরা ঘৃণা করে। ফলে তারা খুব বড় ভূমিকা নেবে।
মোট কথা, ভোট ভাগাভাগি আটকাতে যথাসম্ভব একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিতে হবে।
মনে রাখবেন ভারতের তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসতে কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার সমর্থন লাগেনা।
এমনকি অতীতে যে সকল সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করেছে তারাও অধিকাংশ জনতার ভোট পায়নি।
ভোট ভাগাভাগির কল্যাণে চিত্রটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে ৩৫%-৪০% ভোট পেলেও সে ভারত শাসনের (পড়ুন শোষণ) অধিকার লাভ করে।
তাহলে অঙ্কটা কী দাঁড়াল?
যে করেই হোক বিজেপি কে ৩৫% এর নিচেই আটকাতে হবে।
আর টাকার খনির মালিক (বর্তমানে সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক হল কিন্তু বিজেপি) এই পার্টিকে এত কম স্কোরে বেঁধে রাখতে গেলে ভোট ভাগাভাগি আটকানো ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছিনা।
বাম, কংগ্রেস, আপ, এসপি, বিএসপি, ডিএমকে সহ দেশের মুখ্য বিরোধী দলনেতারা এই সহজ অঙ্ক কেন বুঝতে পারছেন না তা এক বিষ্ময়।
এমনকি ২৩ মে, ২০১৯ বিজেপির কাছে পর্যুদস্ত হয়েও তাদের হুঁশ ফিরছেনা।
আমার এই কথা শুনে অনেক তাত্ত্বিক বামবুদ্ধিজীবি হয়তো হাসছেন।
সে আপনারা হাসতেই পারেন।
আমি যে রাজনীতির তত্ত্বকথায় আপনাদের মত পন্ডিত নয় সে তো আমি আগেও স্বীকার করেছি।
এইসকল ব্যক্তিরা হয়তো মোদী তথা বিজেপির সাম্প্রতিক কিছু খুচরো পরাজয় দেখে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় স্বপ্ন দেখছেন যে মোদীবাবু হেরে ভূত হয়ে স্টেশনে চা বেচতে শুরু করেছে।
উত্তরপ্রদেশ সহ চারটি বিধানসভা ভোটে বিজেপির জয়ে যদি তাদের দিবাস্বপ্ন কাটে তো মঙ্গল।
এই জয়ের ফলে কৃষক আন্দোলনের সামনে পরাজিত হওয়া হতোদ্যম মোদী-শাহ জুটি কিন্তু আবার ২০২৪ এও কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার রাস্তা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।
পরিস্থিতি কিন্তু প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে।
বিজেপি যে হারে মানুষের মনে বিদ্বেষের বিষ ঢুকিয়েছে সেটা কী বিশাল প্রভাব ফেলছে তা আমাদের ধারণারও বাইরে।
কার্ল মার্কসের বলে যাওয়া ধর্মের আফিম যে আসলে কতটা মারাত্মক তা উত্তরপ্রদেশ যোগী আদিত্যনাথের চূড়ান্ত অপশাসনের পরেও ক্ষমতায় ফিরে আসা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। প্রথমেই সে নিজেকে হিন্দুদের রক্ষাকারী হিসাবে প্রতিপন্ন করে নির্বাচনকে ৮০% হিন্দু বনাম ২০% মুসলিমের লড়াইতে পরিণত করল। এই বিজেপি সমর্থক হিন্দু কিন্তু বুঝতে পারছে যে তাদের জীবন-জীবিকা সবই বিপন্ন তবুও তারা ভোট দিতে যাচ্ছে কারণ বিজেপি না জিতলে নাকি মুসলমানদের রাজত্ব চলে আসবে।
এরপরে আসছে হিন্দুদের ভিতর জাতপাতের অঙ্ক। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির মূল ভোটব্যাংক হল তথাকথিত উচ্চ বর্ণের হিন্দু অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ঠাকুর, ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। বেকারত্ব কিন্তু এদেরও ঘরে ঢুকে গেছে। কারণ আজকের দিনে তো জাত ধুয়ে জল খাওয়া যায়না। কিন্তু তবু তারা কংগ্রেস বা সমাজবাদী পার্টিকে ভোট দিলনা। কারণ ওগুলো নাকি মুসলমান আর যাদবদের দল। আবার মায়াবতীর বিএসসি হচ্ছে দলিতদের দল। সোজা ভাষায় না খেয়ে মরব সে তবু মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একজন মুসলিম বা যাদব বা দলিত এমএলএ হয়ে উঁচুজাতের মাথায় বসবে তা চলবেনা। এই ধর্মীয় বিদ্বেষের সুযোগেই বারবার বিজেপি জিতে বেরিয়ে যাচ্ছে।
গোবলয়ের কথা ছেড়ে দিলাম।
তথাকথিত সংস্কৃতিমনষ্ক বাঙালিমননেও একটু দৃষ্টি দিলেই আপনি সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা টের পাবেন।
এমনকি তথাকথিত বাম পরিবারের অনেক মানুষের মধ্যেও এরকম সুপ্ত ইচ্ছা আছে, "শালা মোল্লাগুলো খুব বেড়েছে, ওদের একটু টাইট দেওয়া দরকার"।
তাদের ভিতরের শ্রেণী চেতনার লাল রং কখন গেরুয়া হয়ে গেছে তারা নিজেরাই জানেননা।
নিশ্চিত জানবেন এইসব ভোটের একটা বড় অংশ কিন্তু বিজেপির ঝুলিতেই পড়বে।
আর সবশেষে আছে ইভিএম রহস্য।
ইভিএম কারচুপি ভারতে হয় কিনা এবিষয়ে বিতর্ক আছে। ফলে আপনার বিজেপি বিরোধী ভোট যে বেলাশেষে বিজেপির খাতায় জমা পড়ছেনা সেই নিশ্চয়তা নেই।
আমি মুখ্যু মানুষ সোজাভাবে বুঝি, সোজাভাবেই বলি।
বাকি সিদ্ধান্ত আপনার।
2 মন্তব্যসমূহ
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মূলক সুন্দর লেখা।
উত্তরমুছুনভালো লেখা
উত্তরমুছুন