ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে যে কোন সুস্থ রুচির মানুষের গর্ববোধ থাকা উচিত।
তার উন্নয়নের প্রচেষ্টাও প্রতিনিয়ত করতে হবে।
এই নিরন্তর প্রচেষ্টাই নিজের তথা নিজের ভাষা, সংস্কৃতির বিকাশের মূল পথ, সঠিক পথ।
উদাহরণ স্বরূপ বাংলাভাষার কথাই ধরা যাক।
বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি তাতে সন্দেহ নেই।
যেচে অবাঙালি সেজে নিজেকে আধুনিক ভাবতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার।
তাই বাংলাভাষার মানোন্নয়ন খুব কঠিন।
বর্তমানে এই সমস্যা আরও জটিল কারণ এই ভাষাকে আমরা কাজের ভাষাতে পরিণত করতে পারিনি।
নিরপেক্ষ সত্য এটাই যে এই ভাষাতে উচ্চমানের সাহিত্যচর্চা ছাড়া আর কিছুই নেই।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আপনি একটাও উপযুক্ত মানের পাঠ্যবই বাংলাতে পাবেন না।
ম্যাথম্যাটিকস অনার্স পড়তে গিয়ে আমি বিষয়টা খুব ভালো অনুভব করেছিলাম।
কারণ বাংলাতে যেসব বই আছে তা এত নিম্নমানের যে তা পড়লে আপনি শেষ। গ্র্যাজুয়েশন স্তরের বইতে বৈজ্ঞানিক, গাণিতিক শব্দগুলির অনাবশ্যক বাংলা পরিভাষা ব্যবহার করে বিষয়কে আরও জটিল করে তোলা হয়। এক্ষেত্রেও শ্রদ্ধেয় বাঙালি রাজশেখর বসুর (পরশুরাম) মতামত মনে রাখা জরুরি। তার বক্তব্য ছিল যেকোন ভাষা হচ্ছে চলমান নদীর মত, তাতে সময়ের সাথে সাথে বহু বিদেশি শব্দ যুক্ত হয়ে গতিশীল করে তোলে। সেজন্য বৈজ্ঞানিক শব্দগুলিকে সবক্ষেত্রে জোর করে বাংলা তর্জমা না করে সরাসরি ইংরেজি থেকে বাংলা শব্দকোষের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কিন্তু, সে তো হয়না। ফলে
বাধ্য হয়েই আপনাকে ইংরেজিতে পড়তে হবে।
আরও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তো বিষয়টা আরও করুণ।
অতএব, পরিস্থিতি এমনই যে আপনি যতই কট্টর বাঙালি হন না কেন জীবনে এগোতে গেলে আপনি বাংলা ভাষা ছাড়তে বাধ্য।
সমাধানের উপায় কী?
পথ দেখিয়েছিলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
তিনিই বলতে পেরেছিলেন, "যারা মনে করেন বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হয়না তারা হয় বাংলা বোঝেননা নাহলে বিজ্ঞান বোঝেননা"।
বাংলাতে বিজ্ঞান বই লেখার কাজ তিনি শুরু করেছিলেন।
কিন্তু তার মৃত্যুর পরে আমরা সেই কর্মযজ্ঞ কিছুই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কর্মসংস্থান।
আজকাল বাঙালির অধিকার রক্ষার কিছু স্বঘোষিত কর্তার উদ্ভব হয়েছে।
তারা স্লোগান দেন বাংলাতে ভুজিয়া, ধোকলা চলবেনা।
সোজাভাবে বলতে চান বাংলাতে মাড়োয়াড়ি, গুজরাটিদের ব্যবসা করতে দেবেনা।
বর্তমানে বাংলাতে এদেরই ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি সেকথা সবাই স্বীকার করবে।
কিন্তু এদের জোর করে তাড়ালে বিকল্প কর্মসংস্থান কী হবে?
বাঙালির ছেলেরা কোথায় কাজ করবে?
অতএব বাঙালির অধিকার রক্ষার জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান করতে হবে।
এক্ষেত্রেও পথ দেখিয়েছিলেন আরেক বাঙালি তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র।
কিন্তু তিনি মারা যেতেই আমরা সেই পরিশ্রম সাধ্য পথও পরিত্যাগ করেছি।
তাই বিকল্প কর্মসংস্থান না করে যদি জবরদস্তি করতে যান তাহলে বাঙালিরাই পিটিয়ে 'পক্ষী'র ডানা ভেঙে দেবে।
জবরদস্তি করলে মানুষ যে তা ভালভাবে মেনে নেয়না সেটা 'ঘরে বাইরে'তে সবচেয়ে ভাল দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
জাতীয়তাবাদ দেখাতে গিয়ে বিদেশি দ্রব্য পোড়ানো যে সঠিক সমাধান নয় তা তিনি বুঝেছিলেন।
কারণ দেশের হতদরিদ্র জনতার বেশি দাম দিয়ে স্বদেশী কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই।
তবে শুধু বিরোধিতা করে তিনি কিন্তু থেমে থাকেননি।
নিজ উদ্যোগে তিনি স্বদেশী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সেই উত্তাল স্বদেশী যুগেও সীমিত সাধ্য নিয়ে দেশনায়কেরা কিন্তু শুধু ইংরেজদের স্কুল, কলেজে পড়বনা আওয়াজ তুলেই ক্ষান্ত হননি। কারণ তাহলে তো কাজই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। একই সাথে তারা স্বদেশী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তারা সেই পরাধীন যুগে দাঁড়িয়ে তা করতে পারলে আজ আমরা তা করতে পারবনা কেন?
এটাই হল মূল কথা। কেন্দ্র সরকারের চাপিয়ে দেওয়া হিন্দি আগ্রাসনের কথা কখনোই অস্বীকার করছিনা। নিজেদের জাতিস্বত্বার অস্তিত্ব রক্ষা করতে তার সাথে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করতেই হবে। কিন্তু লড়াইয়ের কিছু কৌশল আছে।
যদি বাঙালি আবেগ জাগাতে হয়, তার মানোন্নয়ন করতে হয়, তাহলে আগে বিকল্প ব্যবস্থা করে নিজেদের শক্তিশালী করতে হবে।
হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে বাংলা সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে হবে। ঠিক যেভাবে তামিল এবং অন্য দক্ষিণ ভারতীয় জনগোষ্ঠী লড়াই করছে।
কিন্তু সেই পথ পরিশ্রম সাধ্য কঠিন পথ।
অথচ বাংলা সংস্কৃতির ধারক বাহক বলে দাবি করা গোষ্ঠীর লোকেরা এই পথ এড়িয়ে গিয়ে সস্তা চমক দেখানো পথ নিয়েছেন।
তারা হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ার নামে হিন্দি বিদ্বেষ ছড়াতে চাইছেন।
'ঘরে বাইরে'র সন্দীপের মতোই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়ত পরে বোঝা যাবে।
যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন মানুষকে বিচার করতে গেলে তার অর্থনৈতিক অবস্থা অবশ্যই বিচার করতে হবে। যে দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক-শ্রমিক বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে কাজের খোঁজে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেছে তার সাথে বাঙালি মুটেমজুরের শ্রেণীচরিত্রগতভাবে কোন ফারাক নেই। বাঙালি মুটে শুধুমাত্র বাঙালি বলে রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্য গুলে খেয়েছে, আবার বিহারি পান্ডেজি মুটে হলেও সে প্রেমচন্দ মুখস্থ করে ফেলেছে, ফলে সুযোগ পেলেই একে অন্যের সংস্কৃতি গ্রাস করে ফেলবে তা হাস্যকর শিশুতোষ কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। এই দুই দিন আনি দিন খাই মানুষের একটাই ধর্ম, একটাই সংস্কৃতি তা হল পেটের ক্ষিদে। এই জায়গায় দুজনেই সমান। তাই রাস্তার ধারে লিট্টি, ছাতুর ঠেলা দেওয়া পান্ডেজিকে পিটিয়ে তুলে দিলে বাঙালি জাতির কিছুমাত্র জাগরণ ঘটবেনা। বরং এই জাতি বিদ্বেষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রবাসী বাঙালিদের ভুগতে হতে পারে। অনেকে বলবেন, কিন্তু এরা গেঁড়ে বসছে, একজন থাকতে পেলেই চৌদ্দ গুষ্টিকে নিয়ে চলে আসছে, বাঙালির কর্মসংস্থানে ভাগ বসাচ্ছে। আরে মশাই, এইজন্যই তো বললাম নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে বাংলার অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র ভূমিপুত্রদের হাতেই থাকবে। সেটা যদি করতে পারেন তাহলে ক'জন বিহার, উওরপ্রদেশ থেকে মজুরি করতে এল তাই নিয়ে আর ভাবতে হবেনা।
কিন্তু, বাস্তবক্ষেত্রে আমরা এর বিপরীতই করছি। আমরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে কাজটাও সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে করিনা। তখন কিন্তু কর্ম-সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে অফিসে সারাদিন ক্রিকেট আর পলিটিক্যাল আড্ডা মেরে দিনের শেষে ফাইল পেন্ডিং রেখে বাড়ি চলে আসি। তাছাড়া বাঙালির 'কাঁকড়া'র স্বভাব সবারই জানা। কোন বাঙালি যদি একটু উপরে ওঠে সে অন্য বাঙালি কিভাবে উঠে আসবে তার চেষ্টা তো করেইনা, পারলে ল্যাং মেরে আরও নিচে ফেলে দেয়। বিহারি বা তামিলদের ভিতর কিন্তু এই জিনিস দেখতে পাবেন না। শুধু সরকারি অফিস নয় কর্পোরেট অফিসে উচ্চপদে চাকরি করা বাঙালির মধ্যেও এই কাঁকড়া সুলভ মানসিকতা দেখা যায়। মনে করুন, এক ব্যক্তি যে কলকাতার কোন কর্পোরেট ব্রাঞ্চ অফিসের প্রধান ছিল এবং সেখান থেকে পদোন্নতি পেয়ে মুম্বাইয়ের সেন্ট্রাল অফিসে আরও উঁচু পদে আসীন হল। এবার তার উচিত সেন্ট্রাল অফিসে এমন ভাবমূর্তি বানানো যাতে কলকাতা তথা বাংলায় আরও ব্রাঞ্চ তৈরি হয়, তাহলে আরও দুটো বাঙালির কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বাস্তবে তিনি মুম্বাইয়ের বড় বাবু হতেই বলতে শুরু করেন, "আরে বাঙ্গাল মে কুছ কাম নেহি হোতা, সব লোগ কামচোর হ্যায়"। এইভাবে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা বাঙালি ছাড়া আর হয়তো কেউ পারেনা।
কিন্তু এদিকে বাঙালি যখন তখন সংস্কৃতির পোকা মাঝেমধ্যে কিলবিলিয়ে তো উঠবেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় গরম গরম বক্তব্য রেখে নিজেকে বিশাল কেউকেটা দেখানোর অভ্যাসও ছাড়া যায়না।
এই সস্তা বাতেলাবাজির বেশ কিছু উদাহরণ চোখে পড়ল।
একজন লিখেছে, আমাদের মধুসূদন আছে তাই ওসব বালছাল তুলসীদাসের দরকার নেই।
আবার দেখলাম, অন্নদামঙ্গলের ব্যজস্তুতির নমুনা দিয়ে লেখা হচ্ছে ওদের আছে তো বালের এক প্রেমচন্দ।
যেসকল কুশিক্ষিত বাঙালি কে দশবছর সাদা কাগজ দিয়ে বসিয়ে খেতে দিলেও তারা তুলসীদাস বা মুন্সি প্রেমচন্দের মত একটা লেখাও লিখতে পারবেনা তারাই এরকম নোংরা কথা লিখে নিজেদের খাঁটি বাঙালি প্রমাণ করতে চাইছে।
যার ফলশ্রুতি শুধু বাঙালির সর্বনাশই হতে পারে।
ছোটবেলায় আমার স্কুলশিক্ষক বাবা শ্লেটে একটা লাইন টেনে প্রশ্ন করেছিলেন, "বলত বাবু এই লাইনটাকে কিভাবে না মুছে ছোট করবি?"
আমি না পারায় তিনি পাশে আরেকটা বড় লাইন টেনে বলেছিলেন, "অন্যকে ছোট করতে হলে আগে নিজেকে বড় হতে হয়"।
দুঃখের বিষয় বাঙালি ঘরের এত সহজ শিক্ষা এদের কেউ শেখায়নি।
0 মন্তব্যসমূহ