দ্য কাশ্মীর ফাইলস - মণীশ রায়চৌধুরী

দ্য কাশ্মীর ফাইলস! চারপাশে শুধু একটাই সিনেমার নাম শোনা যাচ্ছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের নেতৃবৃন্দ এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী সংসদে এই সিনেমা নিয়ে চর্চা করছেন। বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্য যেমন উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরায় এই সিনেমাকে ট্যাক্স ফ্রি ঘোষণা করা হয়েছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই সিনেমা দেখার জন্য সরকারি কর্মচারীদের ছুটি দিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে এই সিনেমা দেখা 'জাতীয়তাবাদ' এবং 'হিন্দুত্ববাদে'র অন্যতম পরাকাষ্ঠা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাজীবনে হাতে গোনা কয়েকটি সি-গ্রেড ফ্লপ সিনেমা পরিচালনা করা বিবেক অগ্নিহোত্রী রীতিমতো জাতীয় বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন। সরকার তাকে Y ক্যাটেগরির সুরক্ষা প্রদান করছে। প্রচন্ড প্রচারের ফলে তৈরি হওয়া একপ্রকার গণহিস্টিয়ায় ভর করে সিনেমাটি ইতিমধ্যেই ২৫০ কোটির গন্ডি পার করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে সরকার এবং তার বশংবদ মিডিয়া বাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে কোন সিনেমার প্রচার করেছে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। তাই এই সিনেমা নিয়ে কৌতুহল হওয়াই স্বাভাবিক। 


এবার মূল প্রসঙ্গে আসি।

কাশ্মীর ফাইলসের প্রধান USP মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে অর্থাৎ এটা নাকি কোন চেপে রাখা গোপন সত্যকে তুলে ধরছে (মানে কংগ্রেস লুকিয়ে রেখেছিল বিবেক বাবু বিবেকের তাড়নায় বের করলেন)। আসল কথা হল কাশ্মীর নিয়ে যারা সত্যি করে জানতে বা পড়াশোনা করতে আগ্রহী তাদের কাছে এই সিনেমা (যদিও একে সিনেমা না বলে সরকারি প্রোপাগাণ্ডা বলতে চাই) কোনই নতুন তথ্য দিতে পারবেনা। কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপর বর্বর অত্যাচার, তাদের বিতাড়ন, তার পিছনে কার, কতটা দায় আছে। কেন কংগ্রেস, বিজেপি এসব সমস্যা সমাধান না করে ফেলে রেখে বছরের পর বছর রাজনীতি করে সবকিছুই যদি কেউ জানতে চায়, পড়তে চায় এই সিনেমা না দেখেই পারবে আরও ভালো পারবে। 

অবশ্য যারা সিনেমা দেখে ইতিহাস পড়তে চায় তাদের কথা আলাদা। 


বিবেক অগ্নিহোত্রীর যদি সত্যিই দেখানোর উদ্দেশ্য হত তাহলে তিনি সম্পূর্ণটাই নিরপেক্ষ ভাবে দেখাতে পারতেন। 

১৯৯০ এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত কিভাবে তৈরি হল। ১৯৪৭ থেকেই কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কিভাবে চেপে রাখা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা ঘটানো হয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের ভিতর তাদের ধর্মের মৌলবাদীরা কিভাবে বিষ ঢুকিয়ে কাশ্মীরিদের মূল সমস্যা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল দেখানো, অন্তত উল্লেখ করা দরকার ছিল। তাতে ১৯৪৭-৪৮ এ রাজা হরি সিংয়ের মদতে জম্মুতে মুসলিমদের ব্যাপক গণহত্যার দিকটাও জানানো হত সেটা তো কাশ্মীরি পন্ডিতদের হত্যার থেকে অনেক বড় ঘটনা ছিল। ১৯৪৮ সালের ১০ আগস্ট লন্ডনের 'দ্য টাইমস' পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, "2,37,000 Muslims were systematically exterminated-unless they escaped to Pakistan along the border-by the forces of the Dogra state headed by the Maharaja in person and aided by Hindus and Sikhs." 

তিনি তো একবারও বললেননা ১৯ জানুয়ারি, ১৯৯০ কাশ্মীরি পন্ডিতদের গণহত্যা ও বিতাড়নের সময় কেন্দ্রে বিজেপি সমর্থিত ভিপি সিংয়ের জনতা দল সরকার ছিল। ৮৫ এমপি সমেত বিজেপি সেই সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। রাজ্যে ছিল রাষ্ট্রপতি শাসন। ক্ষমতাসীন ছিলেন বিজেপিরই অনুমোদিত রাজ্যপাল জগমোহন। এমনকি উইকিপিডিয়াতে পর্যন্ত জগমোহনের ভূমিকা সন্দেহজনক ছিল তার উল্লেখ আছে। একটু পড়লেই জানা যায় তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্যানিক তৈরি করেছিলেন যে প্রশাসন হিন্দুদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবেনা, সবাইকে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করতে হবে। RTI এর জবাবে প্রশাসন লিখিত জানিয়েছে সেই জঙ্গি হামলায় হিন্দুদের থেকে মুসলমান অনেক বেশি মারা গেছে। সেগুলো তো বলেনি। আসলে মুজাহিদিনরা সেই প্রত্যেকটা মানুষকে (হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে) মেরেছে যারা কাশ্মীরিদের মূল ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করেছে যারা ধর্মীয় বিদ্বেষের সহযোগী হতে চায়নি। কমরেড তারিগামির বিবৃতিতে এটা খুব ভাল উঠে এসেছে। সিনেমায় বিবেক এটাও দেখাননি যে তার পরে বাজপেয়ী সরকার এবং বর্তমান মোদী সরকার কাশ্মীরি পন্ডিতদের ফেরত যাওয়ার কোন ব্যবস্থা করেনি। অথচ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পূর্বে তার প্রতিশ্রুতি ছিল যে কাশ্মীরি পন্ডিতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। বরং সত্য এটাই মনমোহন সিংয়ের সরকার অপর্যাপ্ত হলেও কিছুটা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল।


এবার কাশ্মীরিদের কথায় আসি যাদের জন্য বিবেকের প্রাণ কাঁদছে। 'কাশ্মীরি পন্ডিত সংঘর্ষ সমিতি' থেকে শুরু করে কাশ্মীরি পন্ডিতরাও এই সিনেমার তথ্য বিকৃতি এবং সহানুভূতির নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরোধিতা করছে। 

নিহত কাশ্মীরি পন্ডিতদের সংখ্যা এবং মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাকেও অনেক বাড়িয়ে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। যেমন ১৯৯০ এর ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত 'নিখিল ভারত কাশ্মীরি পন্ডিত সম্মেলনে' বলা হয়েছিল ১৯৮৯ এর সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় ৬৫,০০০ হিন্দু কাশ্মীর থেকে পালিয়েছেন এবং ৩২ জন জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন। 'ইন্ডিয়া টুডে' পত্রিকার ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩ সালের রিপোর্ট অনুসারে হিন্দুদের ২৩ টির ভিতর ২১ টি মন্দির অক্ষত ছিল। সেই অশান্ত সময়ে বিজেপির মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ তার 'দ্য চ্যালেঞ্জ ইন কাশ্মীর' বইতে লেখেন, পন্ডিতদের বাড়িঘর তেমন কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এবং প্রতিবেশী মুসলমানরা সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করছে। সেইসময় জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়া সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন খান্নার হত্যার দৃশ্য নিয়ে সিনেমায় খুব দেশপ্রেমের সুড়সুড়ি দেওয়া হয়েছে। অথচ, ক্যাপ্টেন খান্নার স্ত্রী কোর্টে এই সিনেমায় তার স্বামীর হত্যা সংক্রান্ত ঘটনায় তথ্য বিকৃতির অভিযোগ করেছেন। পন্ডিত বালকৃষ্ণ গঞ্জুকে হত্যা করে তার রক্তে ভেজা চাল তার স্ত্রীকে খাওয়ানোর দৃশ্য দেখিয়ে কৌশলে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। অথচ তার ভাই শিবন কৃষ্ণ গঞ্জু 'দৈনিক ভাস্কর' পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তার দাদা প্রাণের ভয়ে চালের ড্রামে লুকিয়েছিলেন, জঙ্গিরা তাকে খুঁজে বের করে আটটা গুলি মেরে হত্যা করলেও তার স্ত্রী, সন্তান আর বাড়ির বাকিদের এই বলে জীবিত ছেড়ে দেয় যে কাউকে তো লাশের উপর কাঁদতে হবে। অর্থাৎ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে রোমহষর্ক করে তোলার জন্য তথ্যবিকৃতি করা হয়েছে। ১৯৫০ সালে মারা যাওয়া সর্দার প্যাটেলকে ১৯৫২ সালে নেহেরুর ৩৭০ ধারার বিরোধিতা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই পুরনো ফর্মুলা। আরএসএসের যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা ছিল একটা বিরাট শূন্য তাই কংগ্রেসের প্যাটেলকে মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে নেহেরুর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি। 


ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রাক্তন ডিরেক্টর এ.এস.দুলাট এই সিনেমার তীব্র নিন্দা করে জানিয়েছেন, "The Kashmir Files is a propaganda. I don't watch propaganda movie. When Jagmohan was reappointed as governor by V.P.Singh government, 5 militants had been released from jail in 1989 & after that killings started in the valley. There’s no doubt about it that pandits were targeted but muslims were targeted, very much." 


এরকম আরও অনেক কথা বলা যায়। বিবেক আসলে কোন সত্য তুলে ধরতে চাননি। তিনি হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তাতে তিনি সফল। এই সিনেমা দেখা এখন তথাকথিত দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট পাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার। আসলে এটা ২০২৪ এর জন্য তৈরি প্রোপাগাণ্ডার একটা পার্ট। ঠিক যেমন ১৯৪০ সালে হিটলার ইহুদি বিদ্বেষ ছড়িয়ে কার্যসিদ্ধি করতে 'The Eternal Jew' সিনেমা তৈরি করিয়েছিল। 


অনেকে বলবে এতে তো সাধারণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়নি।

সব কথা সরাসরি বলতে হয়না। ২০১৪ থেকে মোদীর প্রোপাগাণ্ডার মেশিনারি এতটাই সক্রিয় যে সারা দেশ বারুদের উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটা মানুষ যারা সিনেমাটা দেখতে যাচ্ছে (বিশেষত যাদের মনের কোনায় ১% ধর্মীয় বিদ্বেষ আছে) তারা হিউম্যান বম্ব হয়ে হল থেকে বেরচ্ছে।

আমরা অনেকেই ভাইরাল একটা ভিডিও দেখেছি যেখানে হলের ভিতরেই এক 'হিন্দুবীর' কিভাবে মুসলিম মেয়েদের থেকে বাচ্চা জন্ম দিয়ে তাদের সংখ্যা কমাতে হবে তার ক্যাম্পেনিং করছিল।

প্রতিটি যুক্তিমনস্ক মানুষের এই সিনেমার পিছনে মূল উদ্দেশ্যকে জনতার সামনে তুলে ধরা উচিত বলে আমি মনে করি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ