গান্ধী: নাম তো শুনা হি হোগা - মণীশ রায়চৌধুরী



একটা শীর্ণকায় বৃদ্ধ লোক খালি গা, খাটো ধুতি পরে লাটসাহেব থেকে ভাইসরয়ের বাড়ি সর্বত্র চলে যাচ্ছে। একটা 'আনকালচারড নেটিভের' এতবড় স্পর্ধা সহ্য হয় নাকি!

উইনস্টন চার্চিল ১৯৩১ সালের অ্যান্টি-কলোনিয়াল অ্যাডভাইজরিতে লিখলেন, "It is alarming and nauseating to see Mr. Gandhi, a seditious Middle Temple lawyer, now posing as a fakir of a type well-known in the East, striding half-naked up the steps of the Vice-regal Palace."

অর্থাৎ, অমন রাজকীয় প্রাসাদে গান্ধীর মত এক অর্ধ-উলঙ্গ ফকিরকে দেখেই প্রায় অর্ধেক পৃথিবীর অধিশ্বর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের বমি পাচ্ছিল।

তিনি আরও লিখলেন, "Gandhi should not be released on the account of a mere threat of fasting. We should be rid of a bad man and an enemy of the Empire if he died."


কিন্তু ঘটনাচক্রে ইতিহাস সেই শীর্ণকায় বৃদ্ধকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলল যে মৃত্যুর এতবছর পরেও তাকে স্থানচ্যুত করা গেলনা।

আজকের তারিখে কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ইংল্যান্ড গেলে চার্চিলের বাড়ি নাও যেতে পারেন। কিন্তু ভারতে গেলে গান্ধীর সাথে তাকে 'সাক্ষাৎ' করতেই হবে। 

বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জননকেও তাই সবরমতী আশ্রমে এসে তারই কাছে মাথা নোয়াতে হল যার সম্পর্কে কোনকালে তারই স্বদেশী এক রাজপুরুষ বলেছিলেন, "গান্ধীকে হাত-পা বেঁধে দিল্লির গেটের সামনে ফেলে দাও, বড়লাট তার হাতিতে করে তার উপর দিয়ে চলে যাক তাহলেই আপদ চুকে যাবে।" 


এটাই সেই অদ্ভুত বৃদ্ধের ক্ষমতা। তিনি কাউকে মারতেও পারতেননা, কাটতেও পারতেননা। তার ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতিও ছিলনা। তিনি অহেতুক বাগাড়ম্বরও করতে পারতেননা। মহাপুরুষ, দিব্যপুরুষ সাজার কোন ইচ্ছা ছিলনা বলেই খ্যাতির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাতে পেরেও অক্লেশে নিজের দোষত্রুটির সব কিছু তিনি নিজেই লিখে যেতে পেরেছিলেন।

লোভে পড়ে ভাইয়ের সোনা চুরি করা, বেশ্যাগমন, মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকা বাবাকে ফেলে রেখে গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে জবরদস্তি করে সঙ্গম, অদ্ভুত সব ব্রহ্মচর্য্যর পরীক্ষানিরীক্ষা সব তিনি নিজেই লিখে গেছেন। এইসব কথা জানাজানি হলে তার দেশনায়ক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে এই চিন্তায় তিনি সত্য বিচ্যুত হননি। কারণ তার ভাষায় তিনি শুধুমাত্র সত্যের কাছে দায়বদ্ধ আর সত্যই তার কাছে একমাত্র ঈশ্বর। যে ঘটনাকে তিনি সত্য মনে করতেন তারজন্য তিনি সর্বস্ব পণ করতে পারতেন। এরফলে তিনি বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। কিন্তু এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তার কাছে সত্যই হল একমাত্র ঈশ্বর। 


তিনি যেহেতু মহাপুরুষ হতে চাননি, তাই তিনি বাণী দিতেননা। হয়তো তিনি দেখেছিলেন যে তার পারিপার্শ্বিক অনেক 'বড়মানুষ' মুখে যা বলেন কাজে তা করেননা। তাই তিনি বললেন, তার আলাদা করে কোন বাণী বা উপদেশ নেই। তার জীবন, তার কর্মই হবে তার বাণী। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজি জনা কুড়ি ছাত্র নিয়ে ফিনিক্স বিদ্যালয় খুলেছিলেন। তার নিজের পুত্রেরাও সেখানেই পড়ত। ভারতে ফিরে আসার পরে ছাত্রদের বাসস্থানের অসুবিধা দেখা দিল। তখন গান্ধীজির অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ফিনিক্সের ছাত্রদের আসার ফলে শান্তিনিকেতনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসে গেল। আশ্রমে এতদিন বর্ণাশ্রমের ভিত্তিতে পংক্তিভোজনের ব্যবস্থা ছিল যা রবীন্দ্রনাথ বহু চেষ্টা করেও পরিবর্তন করতে পারেননি। কিন্তু গান্ধীর অনুপ্রেরণায় সবাই একসাথে বসে খাওয়া শুরু হল। আশ্রমে আরও একটি পরিবর্তন এল। গান্ধীজির উদ্যোগে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে কাজে স্বেচ্ছাব্রতী হতে হল। রান্না করা, বাসন মাজা থেকে শুরু করে মেথরের সব কাজ সবাইকে করতে হতো। ১০ মার্চ, ১৯১৫ সালে গান্ধী এই কাজ শুরু করেন। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রতি বছর ঐ দিন শান্তিনিকেতনে 'গান্ধী দিবস' পালন শুরু করেন। সেদিন সব কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে ছাত্র-শিক্ষক মিলে সব কাজ করত।


এটাই গান্ধীবাদ। 'আচ্ছে দিন আনেওয়ালে হ্যায়' 'না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা', 'ম্যায় দেশ নেহি ঝুকনে দুঙ্গা'র মতো বড় বড় কথা, বড় বড় আদর্শের বাগাড়ম্বর নয়। একদম মাটির কাছে গিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে নিশে তাদেরই জীবনযাত্রার শরিক হয়ে তার মানোন্নয়ন করা।

কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি, এমনকি স্বাধীনতার কালে প্রধানমন্ত্রী পদের একজন দাবিদার জে.বি.কৃপালনি তার স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, তিনি যথন প্রথমবার প্রবল উৎসাহে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে চান বলে গান্ধীজির সাথে দেখা করতে যান, গান্ধী তাকে আশ্রমের পংক্তিভোজনের সারি দেখিয়ে সেখানে চাটনি পরিবেশন করতে বলেন। 


বুড়ো লোকটা এমনই অদ্ভুত ছিল বলেই হয়তো মৃত্যুর এত বছর পরেও কোন পক্ষই তাকে নির্দিষ্ট একটা লেবেল লাগাতে পারেনা। লোকটা উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের থেকে যেমন গালি খায় কট্টর মোল্লাদেরও তিনি চক্ষুশূল। এমনকি বাম বা অতিবামেরাও তার মুন্ডুপাত করতে ছাড়েনা। কিন্তু এদিকে ইতিহাস তাকে এমন এক সুউচ্চ স্থানে বসিয়ে দিয়েছে যে তাকে এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। মুখে যাই বলো, তার প্রতিকৃতির কাছে মাথা নোয়াতে বড়বড় রথী-মহারথীও বাধ্য হয়। তাই একদিকে বিজেপি, সঙ্ঘপরিবার যখন গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসে দেশভক্ত ছিল বলে নিরন্তর প্রচার করে চলেছে। ৩০ জানুয়ারি এলেই শকুন পান্ডের মত নেতৃবৃন্দ গান্ধী প্রতিকৃতিতে গুলি চালিয়ে শত্রু বিজয় দিবস পালন করছে তখনও মোদী-শাহ জুটিকে সেই গান্ধীর ছবিতেই মালা দিতে হচ্ছে। 

এমনকি দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার জন্য আমেরিকা গিয়েও প্রধানমন্ত্রীকে কথা শুনতে হচ্ছে যে তিনি যেন ভুলে না যান যে তিনি গান্ধীর দেশ থেকে এসেছেন। যখনই বিজেপি, সঙ্ঘপরিবার ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে অপমান করে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তুলতে চায় তাদেরই হাতে তিন তিনটি গুলি খেয়ে মারা যাওয়া গান্ধীর ভূত তাদের দেশে, বিদেশে, প্রতিটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাড়া করে বেড়ায়।

সাধে কি আইনস্টাইন গান্ধীজি সম্পর্কে বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মর পক্ষে এটা বিশ্বাস করাও কষ্টকর হবে যে একদিন পৃথিবীর বুকে এরকম একটা লোক চলাফেরা করত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ