বর্তমান ভারতের অধঃপতনের অন্যতম কারণ শ্রেণী চেতনার অভাব। এই দৈন্যতার ফলেই মানুষ তার শত্রু-মিত্র চিনতে বারবার ভুল করছে। ভোটের সময়ও তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত করছে। ফল ভুগছে, কিন্তু ঐ যে বললাম শ্রেণী চেতনার অভাব, ফলে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছে।
মানুষের শ্রেণী চেতনার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবশ্যই বিচার্য। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষ গড়ার একমাত্র মাপকাঠি নয় ঠিকই, কিন্তু অন্যতম জরুরি একটা মাপকাঠি। অন্তত, একটা স্তর পর্যন্ত প্রথাগত শিক্ষা না থাকলে কোন মানুষ নিপীড়িত, বঞ্চিতদের জন্য যতই সৎভাবে আন্দোলনের চেষ্টা করুক একটা সময়ে বাধাপ্রাপ্ত হবেই। আধুনিক শিক্ষার অভাবে তার পক্ষে বিশ্বে পূর্বে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের সফলতা বা ব্যর্থতার উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া সম্ভব হবেনা। প্রয়োজন অনুসারে নতুন রণকৌশল অবলম্বন করার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা দেখা যাবে। আধুনিক শিক্ষার অভাবে সংগ্রামী জনতাকে ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করা গেছে, তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে এমন উদাহরণও বিরল নয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোল, ভিল, মুন্ডা বা চুয়াড় বিদ্রোহ সেই সময়ে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু ইংরেজরা সেই বিদ্রোহ দমন করতে সফল হয় কারণ বিদ্রোহী জনতার কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব ছিল।
ভারত বহু ভাষা, ধর্ম, জাতির দেশ। তাই ইউরোপীয় দেশগুলোর মত এখানকার মানুষের শ্রেণীচরিত্র বোঝা অত সহজ নয়।
লোকসভা বা বিধানসভা প্রতিটি নির্বাচনেই প্রার্থীর ভাষা, জাতি, ধর্ম বড় ভূমিকা পালন করে।
মহারাষ্ট্রকে ভারতের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘকাল এখানে কংগ্রেসের শাসন ছিল। তারপর মারাঠি অস্মিতার উপর ভর করে বালাসাহেব ঠাকরের উত্থান শুরু হল। 'মারাঠি মানুষ' আবেগ তৈরি করা হল। নিজের ভাষা, সংস্কৃতির উপর গর্ব অবশ্যই ভালো। কিন্তু যখনই তা অন্যদের প্রতি বিদ্বেষের সৃষ্টি করে তখনই ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। বালাসাহেবও সুকৌশলে মারাঠি আবেগের নামে বিদ্বেষের রাজনীতি শুরু করলেন। মহারাষ্ট্র থেকে মারাঠি বাদে অন্যদের, বিশেষত বিহারিদের মেরে তাড়ানো শুরু হল। ১৯৮৯ সালে তার দল শিবসেনা বিজেপির সাথে জোট গঠন করে। মারাঠা মানেই শিবাজি, শিবাজি মানেই ঔরঙ্গজেবের সাথে দ্বন্দ, মানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ, অর্থাৎ হিন্দুরাজত্বের সূচনা। এমন সহজ সমীকরণই দুটো দলকে কাছাকাছি এনেছিল। ১৯৯৫ তে শিবসেনা প্রথমবার মহারাষ্ট্রতে ক্ষমতা দখল করে। দেখতে দেখতে মহারাষ্ট্রতে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেতে শুরু করেন। তার ইচ্ছাই মারাঠিদের কাছে ঈশ্বরের বিধান হতে শুরু করল। শিবসেনা বা বালাসাহেবের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটা প্রতিবাদী কন্ঠকে মারাঠি ভাবমূর্তিতে আঘাতের অজুহাতে স্তব্ধ করে দেওয়া হতে থাকল। ২০১৬ সালে শিবসেনার ঘোষিত সম্পত্তিই ছিল ৩৯৫.৬৮ মিলিয়ন টাকা। এই বিপুল সম্পদ যে সৎপথে অর্জিত হয়নি সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হতে হয়না। কিন্তু, মারাঠি জনতার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কতটুকু উন্নতি হয়েছে? শাহরুখ, শচীন, অমিতাভের বিলাসবহুল বাড়ি বা জুহুবিচ কি মেরিন ড্রাইভই তো মহারাষ্ট্র নয়। অগণিত মারাঠি মানুষ বস্তিতে গাদাগাদি করে জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে, মারা যাচ্ছে তাদের কতটুকু উন্নতি ঘটল? কিন্তু, মানুষ এইসব প্রশ্ন তুলতেই ভুলে গেছে কারণ শিবসেনা তাদের কাছে মারাঠি আবেগের প্রতীক। বছরের পরে বছর তারা সেই আবেগের ললিপপ চুষে চলেছে।
বিহার এবং গোবলয়ের রাজ্যগুলিতে ভোট হলেও সেই জাতপাত সামনে চলে আসে।
যাদব শুধু যাদব প্রার্থীকেই ভোট দেয়। ব্রাহ্মণ ভোট ঠাকুররা পাবে। দলিত ভোট দলিত বা 'পিছড়া বর্গের' লোক পায়। এবারে উত্তরপ্রদেশের ভোটে জিতে বিজেপির যোগী আদিত্যনাথ পুনরায় সরকার গঠন করেছে। প্রায় কোনরকম জনকল্যাণমুখী কাজ না করেও যে ক্ষমতায় ফেরা যায় উত্তরপ্রদেশ তার নজির হয়ে থাকল। এই জয়ের অন্যতম কারণ ভোট কাটাকাটি। ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্গের দরিদ্র মানুষ আরও বেশি দরিদ্র হয়েছে, অনেকেই কাজ হারিয়েছে। তাদের অনেকেই বুঝতে পারছে এই কুশাসনে তাদের কোন উন্নতি নেই। তবু তারা বিজেপকেই ভোট দেবে। কারণ তাদের বোঝানো হয়েছে বিজেপি হিন্দু ধর্মের রক্ষক এবং তারা না থাকলে মুসলমানরা সব দখল করে নেবে। অর্থাৎ প্রার্থীর যোগ্যতার তুলনায় তার ধর্ম পরিচয় অগ্রাধিকার পেয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক ঠাকুর, ব্রাহ্মণদের বলতে শোনা গেছে মুসলমানদের পার্টি হল , যাদবদের দল সমাজবাদী পার্টি, দলিতদের দল বিএসপি, মানছি যোগী সরকার ততটা উন্নতি করেনি কিন্তু আমাদের দেখার আর কোন দল নেই।
কিন্তু এই ধর্মীয় জাতপাতের গোঁড়ামি শুধু আছে ভাবলে ভুল হবে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় নিজেরাও কিন্তু নিজেদের মানুষ ভাবার পরিবর্তে সংখ্যালঘু প্রমাণ করতেই সচেষ্ট থেকেছে। অত্যন্ত লজ্জাজনক হলেও এটাই সত্য যে এখনও মুসলিম প্রধান অঞ্চলে রাজনৈতিক দলগুলিকে ভোট পাওয়ার জন্য মুসলিম প্রার্থী দিতে হয়। এখানেও প্রার্থীর যোগ্যতার তুলনায় ধর্মীয় পরিচয় অগ্রাধিকার পেয়ে যায়। ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে ওঠার পরিবর্তে ইমাম ভাতা, হজ যাত্রার ব্যবস্থা কোন দল করে দেবে তাতেই তারা বেশি আগ্রহী। তাদের অধিকাংশ ইমাম এবং ধর্মগুরুরাও বুঝে গেছে এই ভেড়ার পালকে ধর্মের আফিমে বুঁদ করে রাখতে পারলেই তাদের ইচ্ছেমতো কাজে লাগিয়ে নিজেদের মৌরসীপাট্টা কায়েম রাখা যাবে।
দলিত, SC, ST, OBC প্রভৃতি তথাকথিত নিচু জাতের মানুষও কিন্তু এই মূর্খতা করে চলেছে। ১৯৬৪ সালে দলিত নেতা কাঁসিরাম পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তার এই লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তার নাম 'বহুজন সমাজবাদী পার্টি'। এরপর মায়াবতীর হাত ধরে দল দ্রুত ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় আসীন হয় বিএসপি, মুখ্যমন্ত্রী হলেন মায়াবতী। স্বাভাবিক ভাবেই দলিতরা তাদের আদরের 'বেহেনজি'র মধ্যে মুক্তিদাতার ছবি দেখেছিলেন।
কিন্তু মায়াবতী গদিতে বসে চূড়ান্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করলেন। জনতার উন্নয়নের অর্থ দিয়ে সারা উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী, কাঁসিরাম এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতীক হাতির স্ট্যাচু নির্মিত হল। মায়াবতী সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের একটি PIL থেকে জানা যায় ৫২.২০ কোটি টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন পার্কে প্রায় ৬০ টি হাতির স্ট্যাচু তৈরি করা হয়। ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ বাজেট বরাদ্দের ২০০০ কোটি টাকার প্রায় ৯০% তিনি ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রচারে অপচয় করেছিলেন।
অথচ, এতকিছুর পরও দলিতদের কাছে তাদের 'বেহেনজি' একজন মসিহা। তারা বিএসপিকেই ভোট দেবে। দলিতদের সঠিক শ্রেণীচেতনা নেই বলেই তারা বুঝতে পারছেনা যে অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন মানুষের শ্রেণীচরিত্র বদলে দেয়। তাই কাঁসিরামের হাত ধরে যে যুব নেত্রী তাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আর যে মায়াবতী গদিতে বসেই ব্যক্তিগত প্রচার এবং দুর্নীতির চোরা স্রোতে ডুব দিলেন দুজন মানুষ এক হলেও কখনোই এক নয়।
এ-ই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। যে জননেত্রী বিরোধী থাকাকালীন কিছুটা হলেও মানুষের পাশে ছিলেন। সিপিএম সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতেন ক্ষমতায় বসার মাত্র ১১ বছরের ভিতরেই তিনি সিপিএমের ৩৪ বছরের রেকর্ডকে বহু পেছনে ফেলে দিয়েছেন।
শ্রেণীচেতনার অভাবে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের দেবতা বানিয়ে ফেলা সংক্রান্ত এই লেখা দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ছাড়া তো সম্পূর্ণ হতেই পারেনা। ফিল্মস্টার হোক বা রাজনৈতিক নেতা, তাদের দেবতা বানানোয় দক্ষিণ ভারতের বিশেষত তামিলনাড়ুর জনতার জুড়ি মেলা ভার। এম.জি. রামচন্দ্রন, করুনানিধি বা জয়ললিতা সিনেমার নায়কনায়িকারা রাজনীতিতে নামতেই চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছেন। সাধারণ জনতা যখন অভুক্ত থেকেছে জয়ললিতা তখন টাকার গদিতে আরাম করেছে। সাধারণ মানুষের থাকার জায়গা নাই থাকতে পারে কিন্তু জয়ললিতার দেশি-বিদেশি জুতোর জন্যও আলাদা ঘর ছিল বলে তার ভক্তরা গর্ব করে থাকে। এমনকি তার মৃত্যুর পরে 'আম্মা'র শোকে অনেকে আত্মহত্যা করেছিল।
দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জনতার চিনতে না পারার একটাই কারণ তা হল সঠিক শ্রেণীচেতনার অভাব। সঠিক চেতনা না গড়ে উঠলে তার একই ভুল করতেই থাকবে। বর্তমানকালের উঠতি নেতা অভিষেক ব্যানার্জি, কানহাইয়াকুমার, কেজরিওয়াল হোক বা আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে ভোটে লড়া রাবণ তাদের ত্রুটিবিচ্যুতি বুঝতে হলে সঠিক রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তুলতে হবে, তবেই নতুন ভারত গড়ে উঠবে।
0 মন্তব্যসমূহ