অশান্ত মনে ঘরময় পায়চারি করছেন এক বৃদ্ধ। দিন কয়েক আগেই ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ ঘটে গেছে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। সহস্রাধিক মানুষ আহত, নিহত। রাজশক্তির দম্ভে এতবড় অন্যায়, অত্যাচার তার কোন প্রতিবাদ হবেনা? এতবড় অত্যাচার কি দেশবাসী মুখ বুজে সহ্য করে নেবে? দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সাথে দেখা করলেন, প্রতিবাদ সভা করতে বললেন, মহাত্মাজিকে পত্র লিখলেন। কিন্তু, বেশ বুঝতে পারছেন কোথাও বিশেষ কোন ফল হচ্ছেনা।
সেই অস্থির চিত্তের কথা উঠে এসেছে শ্রী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের লেখায়, "ভোর হয়নি - হয়তো চারটে হবে -উঠে স্নান করে বেরিয়ে পড়লুম। আকাশ একটু ফর্সা হয়েছে কিন্তু ঘর তখনো অন্ধকার। আমি ঘরে যেতেই মুখ ফিরিয়ে বললেন, কী এসেছো? এই বলে আবার লিখতে আরম্ভ করলেন। দু-তিন মিনিট। তারপরেই একখানা কাগজ হাতে দিয়ে বললেন, পড়ো। বড়লাটকে লেখা নাইটহুড পরিত্যাগ করার চিঠি।...
কবি তখন বললেন --- সারারাত ঘুমোতে পারিনি। ব্যস এখন চুকলো। আমার যা দরকার তা হয়ে গিয়েছে। মহাত্মাজি রাজি হলেন না পাঞ্জাবে যেতে। কাল তাই নিজেই গিয়েছিলুম চিত্তরঞ্জনের কাছে। বললুম যে, এই সময় সমস্ত দেশ মুখ বন্ধ করে থাকবে এ অসহ্য। তোমরা প্রতিবাদ সভা ডাকো। আমি নিজেই বলছি যে, আমি সভাপতি হবো। চিত্ত একটু ভেবে বললে, বেশ। আর কে বক্তৃতা দেবে? আমি বললুম, সে তোমরা ঠিক করো। চিত্ত আরেকটু ভাবলে---বললে, আপনি যদি সভাপতি হন, তবে তারপরে আর কারুর বক্তৃতা দেওয়ার দরকার হয় না। আপনি একা বললেই যথেষ্ট। আমি বললুম তাই হবে। এবার তবে সভা ডাকো। তখন চিত্ত বললে, আপনি একা যখন বক্তৃতা দেবেন, আপনিই সভাপতি, তখন সবচেয়ে ভালো হয় শুধু আপনার নামে সভা ডাকা। বুঝলুম ওদের দিয়ে হবে না। আমি বললুম, আচ্ছা আমি ভেবে দেখি। এই বলে চলে এলুম। অথচ আমার বুকে এটা বিঁধে রয়েছে কিছু করতে পারব না, এ অসহ্য। আর আমি একাই যদি কিছু করি, তবে লোক জড়ো করার দরকার কি? আমার নিজের কথা আমার নিজের মতো করে বলাই ভালো। এই সম্মানটা ওরা আমাকে দিয়েছিল কাজে লেগে গেল। এটা ফিরিয়ে দেওয়ার উপলক্ষ্য করে আমার কথাটা বলার সুযোগ পেলুম।"
কবি ভাইসরয়কে এক পত্রে লিখলেন, "যখন জানিলাম যে, আমাদের সকল দরবার ব্যর্থ হইল, যখন দেখা গেল প্রতিহিংসা প্রকৃতিতে আমাদের গবর্নমেন্টের রাজধর্ম দৃষ্টি অন্ধ করিয়াছে, অথচ যখন নিশ্চয় জানি, নিজের প্রভূত বাহুবল ও চিরাগত ধর্ম-নিয়মের অনুযায়িক মহদাশয়তা অবলম্বন করা এই গবর্নমেন্টের পক্ষে কত সহজ ছিল, তখন স্বদেশের কল্যাণ কামনায়, আমি এইটুকুমাত্র করিবার সংকল্প করিয়াছি যে, আমাদের বহু কোটি যে ভারতীয় প্রজা অদ্য আকস্মিক আতঙ্কে নির্বাক হইয়াছে, তাহাদের আপত্তিকে বাণী দান করিবার সমস্ত দায়িত্ব এই পত্রযোগে আমি নিজে গ্রহণ করিব। অদ্যকার দিনে আমাদের ব্যক্তিগত সম্মানের পদবীগুলি চতুর্দিকবর্তী জাতিগত অবমাননার অসামঞ্জস্যের মধ্যে স্পষ্টতর করিয়া প্রকাশ করিতেছে। অন্তত আমি নিজের সম্বন্ধে এই কথা বলিতে পারি যে, আমার যে-সকল স্বদেশবাসী তাহাদের অকিঞ্চিৎকরতার লাঞ্চনায় মনুষ্যের অযোগ্য অসম্মান সহ্য করিবার অধিকারী বলিয়া গণ্য হয়, নিজের সমস্ত বিশেষ সম্মান-চিহ্ন বর্জন করিয়া আমি তাহাদেরই পার্শ্বে নামিয়া দাঁড়াইতে ইচ্ছা করি।"
রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগের এই ঘটনা শুধু দেশে নয় ইংল্যান্ড, আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হল। এতবড় গণহত্যার ঘটনা সমগ্র বিশ্বের সামনে চলে আসায় শোরগোল পড়ে গেল। তিনি ঠিক এটাই চাইছিলেন। কারণ এতবড় গণহত্যার পরেও মহাত্মাজি সহ কংগ্রেসের অন্যান্য শীর্ষ নেতৃত্ব'র ইংরেজ শাসনের প্রতি মোহভঙ্গ হচ্ছেনা দেখে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন। অমৃতসরে আয়োজিত কংগ্রেসের বাৎসরিক সম্মেলনেও কোন জোরালো প্রতিবাদ ধ্বনিত হলনা। শুধুমাত্র জালিয়ানওয়ালাবাগের শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হল। এই ভূমিকাকে কবি কাপুরুষোচিত আচরণ বলে ধিক্কার জানিয়ে ১৩২৭ সনের বৈশাখে প্রকাশিত 'শান্তিনিকেতন পত্রিকা'য় লিখলেন, "পীড়ন যতই কঠিন হউক সহিব, কিন্তু আত্মাবমাননা কিছুতেই সইব না--- পাঞ্জাবে এইরূপ পৌরুষের বাণী শুনিবার আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু যখন তাহা শুনিলাম না, তখন সর্বাগ্রে আপনাদিগকেই ধিক্কার দিতে হইবে। এই কারণেই আমরা বলি কোনো চিহ্নের দ্বারা পাঞ্জাবের এই ঘটনা চিরস্মরণীয় করা আমাদের পক্ষে গৌরবের নহে। বীরত্বই স্মরণের বিষয়, কাপুরুষতা নৈব নৈবচ।"
১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় তার পরিকল্পনাটি আরও স্পষ্ট করে লিখেছিলেন, "Being aware that a discussion had been raised in regard to my Knighthood, I feel it right to put clearly my own view of it before the public. It is obvious that it was solely to give utmost emphasis to the expression of my indignation at the Jallianwallabagh massacre and other deeds of inhumanity that followed it that I asked Chelmsford to take it back from me."
বলাই বাহুল্য, কবির এই পরিকল্পনা সফল হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী শোরগোলের ফলে ইংরেজ সরকার এই গণহত্যার তদন্ত করতে হান্টার কমিশন গঠন করে। যদিও কমিশন খুব স্বাভাবিক ভাবেই জেনারেল ডায়ারের কুকর্মকে ঢাকার চেষ্টা করে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই নৃশংস ঘটনা ভারতবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
হান্টার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পেতেই রবীন্দ্রনাথ লেখেন, "ভারতের প্রতি এদেশের শাসক সম্প্রদায়ের প্রকৃত মনোভাব নিদারুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে --- পার্লামেন্টের দুটি কামরাতেই ডায়ার সংক্রান্ত সাম্প্রতিক আলোচনা ও বিতর্কমূলে, এর থেকে যে কথাটি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা এই যে, এদেশের যাদের মধ্য থেকে আমাদের শাসনকর্তারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাঁদের আমলারা আমাদের উপর যত দানবীয় অত্যাচারই করুক না কেন, তাতে তাঁদের মনে কোনরকম বিক্ষোভের সঞ্চার হয়না।...ব্রিটিশ জাতির নাড়িতে ঘুন ধরেছে! তার মজ্জা এই দারুণ বিষের প্রতিক্রিয়ায় জর্জরিত হতে চলেছে। আমি অনুভব করছি, যে ওদের মহদানুভূতির উদ্দেশে আমাদের আবেদন প্রতিদিনই ক্রমশ ক্ষীণতর সাড়া পাবে।... সাম্প্রতিক ঘটনাবলী স্পষ্টই প্রমাণ করেছে যে, আমাদের সত্যকার মুক্তি রয়েছে আমাদের আপন হাতে; কোন জাতিরই প্রতিষ্ঠা ও মাহাত্ম্য কারও তাচ্ছিল্য-প্রণোদিত বা অবজ্ঞা-সঞ্জাত কার্পণ্যের মুষ্টিভিক্ষার উপর গড়ে তোলা চলে না।"
গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব মনে করতেন। এবং সেইসময় ভারতীয় রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে তার বক্তব্য কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বর কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব পেত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের তীব্র প্রতিক্রিয়া কংগ্রেসের নেতৃত্বদের প্রভাবিত করতে থাকে। অবশেষে কংগ্রেসের মোহভঙ্গ হতে থাকে।
গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থাকাকালীন বুয়র যুদ্ধে (১৮৯৯-১৯০২) আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস এবং সেবা কার্যের জন্য ১৯১৫ সালে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের থেকে 'কাইজার-ই-হিন্দ' উপাধি লাভ করেছিলেন।
তিনি তার গুরুদেবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯২০ সালের ১ আগস্ট ভাইসরয় চেমসফোর্ডকে চিঠি লিখে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এবং ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ এই স্বর্ণপদক ফিরিয়ে দেন।
পদক ফিরিয়ে দেওয়ার চিঠিতে চেমসফোর্ডকে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে তিনি লিখলেন, "Your Excellency's light hearted treatment of the official crime, your exoneration of Sir Michael O' Dwyer, Mr. Montagu's despatch and above all the shameful ignorance of the Punjab events and callous disregard of the feelings of Indians betrayed by House of Lords, have filled me with the gravest misgivings regarding the future of the empire, have estranged me completely from the present government and have disabled me from tendering, as I have hitherto wholeheartedly tendered my loyal cooperation."
বর্তমান সরকারের অপদার্থতা এবং অপশাসনের প্রতিবাদে বেশ কিছু বিদ্বজ্জন সরকারি খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। শাসকগোষ্ঠীর পোষা মিডিয়ার কল্যাণে আমরা তাদের দেশদ্রোহী, টুকরে টুকরে গ্যাং, অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি গ্যাং বলে ভূষিত করতে শিখে গেছি। মিডিয়ার শেখানো ন্যারেটিভ আমাদের মস্তিষ্কে প্রোগ্রামিং করে দিয়েছে যে সরকারের বিরোধিতা মানেই দেশের বিরোধিতা। সরকারের অপশাসনের প্রতিবাদে খেতাব ফিরিয়ে দেওয়াকে তাই আমরা দেশের অপমান মনে করতে শিখেছি।
সরকার সুকৌশলে আমাদের ভুলিয়ে দিতে পেরেছে ভারতে 'অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি গ্যাং'য়ের মুখিয়া ছিলেন দুই বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর মোহনদাস করমচন্দ গান্ধী।
0 মন্তব্যসমূহ