আপনি একটা বাচ্চা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করুন, দেশভাগ কাদের জন্য হয়েছে? দেখবেন ছেলেটা এক মুহূর্তের ভিতর উত্তর দিয়ে দেবে মুসলমানদের জন্য। দেশভাগের মতো এত জটিল বিষয় যার এতরকম বিবেচ্য দিক আছে তার কিছু মাত্র না জানলেও সে বাল্যকালেই শিখে গেছে মুসলমানদের জন্য দেশভাগ হয়েছে। অর্থাৎ বাল্যকাল থেকেই একটা মিথ্যা প্রচারের কারণে নিজের সহনাগরিকের প্রতি শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে বিদ্বেষ নিয়ে বড় হচ্ছে।
কিন্তু ইতিহাস কী বলে? দেশভাগ কি শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য হয়েছিল? হিন্দুদের কি এর পিছনে কোন ভূমিকা ছিলনা? সমস্ত মুসলমানই কি পাকিস্তান গঠনের দাবির সমর্থক ছিল?
আসুন তাহলে টাইম মেশিনে চড়ে সেই অশান্ত সময়ে ফিরে যাই। শর্ত একটাই কোনরকম ধর্মীয় গোঁড়ামি মাথায় না রেখে মুক্তমনে শুধুমাত্র সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
সত্য এটাই যে মুসলিম লিগ দ্বিজাতিতত্ত্ব ঘোষণা করে দেশভাগের প্রস্তাব উত্থাপনের বহু আগেই হিন্দুত্ববাদীরা এই ধারণার প্রস্তাবনা করেন।
অরবিন্দ ঘোষের মাতামহ রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) এবং নবগোপাল মিত্র (১৮৪০-১৮৯৪) কে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ বলা যেতে পারে। তারা বর্ণপ্রথায় একান্ত বিশ্বাসী ছিলেন। হিন্দুজাতি একদিন জেগে উঠবে এবং খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের পরাজিত করে সমগ্র বিশ্বে হিন্দুধর্মের বিজয় পতাকা ওড়াবে এটা তারা স্বপ্ন দেখতেন। বিজেপি, আরএসএসের বহু পূর্বে এমনকি তাদের মাতৃসংগঠন হিন্দু মহাসভারও আগে তারা সারা ভারত হিন্দু সমিতি গড়ে তুলেছিলেন।
নবগোপাল মিত্রর উদ্যোগে আয়োজিত বাৎসরিক হিন্দুমেলাতে নানা প্রকারে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের উৎকর্ষতার প্রচার করা হত। ১৮৬৭ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত নিয়মিত প্রতি বছর এই মেলা আয়োজিত হয়েছিল। নবগোপাল বলেছিলেন, "ভারতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ভিত্তি হচ্ছে হিন্দুধর্ম। হিন্দু জাতীয়তা ভারতের সকল স্থান ও ভাষা নিরপেক্ষভাবে ভারতের সমস্ত হিন্দুকেই জড়িয়ে আছে।"
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের খুব স্পষ্টভাবেই বুঝেছিলেন যে, "নবগোপাল মিত্র অর্ধশতক আগেই জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বের পুরোগামী ছিলেন।" এবং তখন থেকেই "সচেতন বা অবচেতন ভাবে জাতীয়তাবাদের উপর হিন্দু চরিত্রের ছাপ গভীর ভাবে দাগ কেটে বসে।"
ভাই পরমানন্দ একদিকে ছিলেন আর্য সমাজের অন্যতম প্রচারক, আবার তিনি একইসাথে কংগ্রেস এবং হিন্দুমহাসভার অন্যতম নেতা ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার পরিবর্তে সারাজীবন প্রচুর মুসলিম বিরোধী লেখা লিখেছিলেন। তিনি তার প্রচার পত্রের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য যে একেবারেই অসম্ভব তাই প্রচার করে বেড়াতেন। তার একটি প্রচারপত্রে পাওয়া যায়, "ইতিহাসে হিন্দুগণ পৃথ্বীরাজ, প্রতাপ, শিবাজি এবং বেরাগী বীরের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা করে, যারা এই দেশের সম্মান ও স্বাধীনতার জন্য (মুসলমানের বিরুদ্ধে) সংগ্রাম করেছেন, আর মুসলমানেরা ভারত আক্রমণকারী মুহম্মদ বিন কাশেম এবং ঔরঙ্গজেবের মত শাসকদের জাতীয় বীর বলে মনে করেন।"
ভাই পরমানন্দ তার উর্দুতে রচিত পুস্তিকা 'হামারে কওমি হিরো' তে লিখেছিলেন, "হিন্দু ও ইসলামের অনুগামীগণ দুটি পৃথক জনগোষ্ঠী। কারণ মুসলমানেরা যে ধর্ম অনুসরণ করেন তার জন্মস্থান আরবভূমি। তাই হিন্দুরা ভারতের প্রকৃত সন্তান আর মুসলমানেরা বহিরাগত।"
জিন্নাহ তথা মুসলিম লিগের বহু আগে ১৯০৮-০৯ সালেই তিনি তার আত্মজীবনী 'দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ'-এ লেখেন, "সিন্ধুর ওপারের অঞ্চলটি আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে একটা বৃহৎ মুসলিম রাজ্য গড়ে তোলা উচিত। ঐ অঞ্চলের হিন্দুদের জায়গাটি ছেড়ে চলে আসতে হবে ও বাকি ভারতের মুসলমানদের ওখানে চলে যাওয়া উচিত হবে।"
কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা এবং আর্য সমাজের অপর এক প্রখ্যাত নেতা লালা লাজপত রাই (১৮৬৫-১৯২৮) তারও পূর্বে ১৮৯৯ সালে হিন্দুস্থান রিভিউতে লেখেন, "হিন্দুদের মধ্যে একটি জাতি হয়ে ওঠার মতো সবকিছুই আছে, যে কারণে তারা একটি জাতি হয়ে উঠেছিল।"
১৯২৪ সালে তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বর উপকারিতা ব্যখ্যা করে লেখেন, "আমার পরিকল্পনা মতো মুসলমানেরা চারটি মুসলিম রাজ্য পাবে; উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পাঠান প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলা। যদি ভারতের অন্য কোন অঞ্চলে ঘন মুসলিম জনবসতি থাকে, তবে সেখানে একইভাবে রাজ্য গঠিত হওয়া উচিত। কিন্তু একথা পরিষ্কার বুঝতে হবে যে এখানে কোন সংযুক্ত ভারতের কথা বলা হচ্ছেনা। এর অর্থ ভারতকে পরিষ্কারভাবে মুসলিম ভারত ও অমুসলিম ভারতে ভাগ করতে হবে।"
১৯২৩ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকর তার হিন্দুত্ব বিষয়ক বইতে লেখেন, "খ্রিষ্টান ও মুসলিম সম্প্রদায় যারা কিছুকাল আগেও হিন্দু ছিল এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম পুরুষে এই নতুন গোত্রের সদস্য, সেক্ষেত্রে যদিও আমাদের মতো তাদেরও একই পিতৃভূমি ও শরীরে বিশুদ্ধ হিন্দু রক্ত ও পিতৃ পরিচয় রয়েছে, তবু্ও তাদের হিন্দু বলে মেনে নেওয়া যায়না। কারণ নতুন ধর্মগ্রহণ তাদের হিন্দু সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তারা নিজেদের হিন্দু ভিন্ন সম্পূর্ণ পৃথক একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের অধিকারভূক্ত অথবা অঙ্গীভূত হিসাবে বিবেচনা বিবেচনা করে। তাদের বীরপুরুষ বা বীরপুরুষ স্তুতি, উৎসব, মেলা, তাদের ধ্যানধারণা ও জীবনের প্রতি দৃষ্টি এখন আমাদের থেকে আলাদা।"
১৯৩৭ সালে আমেদাবাদে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার ১৯তম সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, "যেমনটি দেখতে পাই, আজও ভারতে দুটি দ্বন্দ্বমূলক জাতি পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। কতিপয় শিশুসুলভ রাজনীতিবিদ যে ভুলটি করেন তা হল, তারা ধরেই নেন যে ভারত ইতিমধ্যেই একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছে অথবা ইচ্ছানুসারে এভাবে গড়ে তোলা সম্ভব।.........আজ আর ভারতকে সমসত্ত্বরূপে ভাবতে পারা যায়না। পরিবর্তে প্রধানত : দুটি জাতি হিন্দু ও মুসলমান ভারতে বর্তমান।"
আরএসএসের অপর প্রাণপুরুষ এম.এস.গোলওয়ালকর ১৯৩৯ সালে তার বই We or Our nationhood Defined নাৎসি জার্মানি বা ফ্যাসিস্ট ইতালিতে ইহুদি তথা সংখ্যালঘুদের উদাহরণ তুলে মুসলমানদের হুঙ্কার দিয়ে বলেন যে স্বাধীন ভারতে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে হিন্দু জাতির অনুগত ভৃত্যের ন্যায় জীবনধারণ করতে হবে।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী জননেতারাও একইভাবে চাইতেন মুসলমানরা স্বাধীন ভারতে না থাকুক, আর যদি থাকতেই হয় তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুজাতির অনুকম্পার পাত্র হয়ে থাকুক। একহাতে তালি বাজে না। নিঃসন্দেহে বলা যায় এই ধরনের হিন্দু মৌলবাদী চিন্তা পরোক্ষে ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর সুবিধা করে দিয়েছিল। তারা সহজেই এদের উদাহরণ তুলে সাধারণ মুসলিম জনতার একটা অংশকে ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে ভারত কখনোই তাদের আপন দেশ হতে পারেনা, মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান চাই-ই চাই।
মহম্মদ আলি জিন্নাহ তার দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাখ্যা করে লিখলেন, "হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি ও ভাষার অন্তর্গত। তারা যেমন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়না, তেমনি তারা একত্রে ভোজনও করেনা এবং বাস্তবিক এ-দুটি পৃথক সভ্যতা, যা মূলত পরস্পর বিরোধী শত্রুতামূলক ধ্যান-ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে। জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনযাত্রার ধরন পৃথক। এটা পরিস্কার যে ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন উপাদান থেকে তারা উৎসাহ ও উদ্দীপনা আহরণ করে। তাদের পৃথক মহাকাব্য, বীরত্বব্যঞ্জক চরিত্র এবং পৃথক দৃশ্যকাব্য রয়েছে।"
হিন্দু ও মুসলমান যে দুটি আলাদা জাতি এবং তারা যে কিছুতেই একসাথে থাকতে পারবেনা এটা বোঝানোর জন্য ভাই পরমানন্দ, সাভারকর এবং জিন্নাহর বক্তব্যের সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। মনে হয় যেন দুটো আলাদা ধর্মের মৌলবাদী নেতা হলেও তারা কোন একটা জায়গা থেকেই স্ক্রিপ্ট পেয়েছে এবং সেই অনুযায়ী দেশভাগের রঙ্গমঞ্চে নিজেদের ভূমিকায় অভিনয় করছে। মৌলবাদীদের বক্তব্যর এই সাদৃশ্য দেখে ড: বি.আর.আম্বেদকর বলেছিলেন, "আশ্চর্যের বিষয়, দেখা যাচ্ছে যে মি. সাভারকর ও মি. জিন্নাহ একই জাতি ও দ্বিজাতি প্রসঙ্গে একে অপরের বিরোধী হওয়ার পরিবর্তে সম্পূর্ণ ঐক্যমত ছিলেন। তারা দুজনেই স্বীকার করেন এবং শুধু স্বীকারই করেননা যে ভারতে দুটি জাতি-- এক হিন্দু ও দুই মুসলমান। শুধুমাত্র কী কী বিষয় ও শর্তে দুটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে, সে প্রসঙ্গে তাদের বিরোধ ছিল।"
আসলে দুই পক্ষের মৌলবাদীরাই যে দেশভাগের স্ক্রিপটটা একটাই জায়গা (পড়ুন প্রভু) অর্থাৎ ইংরেজদের থেকে পেয়েছিল তাতে কোনপ্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। ইংরেজরা ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম বিদ্রোহীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে দেখেই বুঝতে পেরেছিল যে ভারতকে শাসন, শোষণ করতে হলে হিন্দু-মুসলিমকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতেই হবে।
মৌলবাদীদের ফাঁদে পা দেওয়ার পরিণতি যে কী মর্মান্তিক হতে পারে দেশভাগ এবং লাখো মানুষের প্রাণঘাতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। একটা সুগঠিত সমৃদ্ধ সমাজের পরিবর্তে আমরা পেলাম ক্ষয়িষ্ণু দুটি রাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তান এবং আরও পরে পাকিস্তানেরও বিভাজন হয়ে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। ক্ষমতাবানেরা রাষ্ট্রের গদি পেল। কিন্তু তাদের কথায় নেচে যে সাধারণ হিন্দু, মুসলিম জনতা নিজেদের ভিতর কাটাকাটি করে মরল তারা একটা বিরাট শূন্য ছাড়া আর কিছুই পেলনা। সময় এগিয়েছে, কর্পোরেট প্রভুদের স্বার্থসিদ্ধি করতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা আবার মানুষকে ধর্মের নামে লড়িয়ে দিতে চাইছে।
আমরা কি এখনো কিছুই শিখবনা???
1 মন্তব্যসমূহ
তথ্যবহুল ভালো লেখা
উত্তরমুছুন