আজাদি কা অমৃত মহোৎসব - মণীশ রায়চৌধুরী



স্বাধীনতা! শব্দটা কি মিষ্টি তাই-না?

দেখতে দেখতে আরও একটা ১৫ আগস্ট এসে গেল। পাড়ায় পাড়ায় জাতীয় পতাকার চেন ঝুলছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে জাতীয় পতাকা উড়ছে, আকাশে বাতাসে বলিউডি 'দেশপ্রেমের' গানের সুর ভাসছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তেরঙা পতাকার সাথে ছবি দিয়ে দেশপ্রেমের 'প্রমাণ' দেওয়া। সকাল হতেই টিভিতে বর্ডার, এলওসি কার্গিল থেকে গদর এক প্রেম কথা। দুপুরে মাংসের ঝোল ভাত খেয়ে সিনেমা দেখে পাকিস্তানের গুষ্টি উদ্ধার করে একটা তোফা ঘুম এই না হলে কি আর স্বাধীনতা দিবস উদযাপন জমে। 


তারউপর এবারে আবার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশবাসীকে  'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' পালনের ডাক দিয়েছেন। তিনি দেশবাসীকে ১৩-১৫ আগস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাইকে প্রোফাইল পিকচারে জাতীয় পতাকা লাগানোর আর্জি জানিয়েছেন। তিনি নিজেও টুইটারের ডিপিতে পতাকা লাগিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সবাইকে নিজেদের ঘরে এই তিনদিন পতাকা ওড়াতে অনুরোধ করেছেন। সরকারি নির্দেশে এই 'হর ঘর তিরঙ্গা' ক্যাম্পেন সফল করতে প্রায় ২০ কোটি পতাকা তৈরি করা হয়েছে।


এই পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল। স্বাধীনতা দিবসে নাগরিকেরা জাতীয় পতাকা ওড়াবে, জাতীয় পতাকার মর্যাদা বুঝবে, সম্মান করবে তাতে কোন ভুল নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক। 

কিন্তু একজন যুক্তিবাদীর উচিত সবদিক মুক্তমনে বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এবং তাতেই যত গোলমাল। কারণ মুক্তমনে দেখলেই 'হর ঘর তিরঙ্গা' ক্যাম্পেনের সাথে জড়িত এমন অনেক তথ্য সামনে আসবে যাতে মোদী সরকারের পূর্বের বহু জুমলার মত এর পিছনেও নিজের কর্পোরেট প্রভুদের স্বার্থসিদ্ধি এবং নিজের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিই চোখে পড়বে।


এতদিন পর্যন্ত খাদি নির্মিত পতাকা সমস্ত সরকারি অনুষ্ঠান, অফিসে ব্যবহৃত হত। ভারত সরকার অনুমোদিত BIS সার্টিফিকেট প্রাপ্ত একমাত্র সংস্থা 'কর্ণাটক খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘ (ফেডারেশন)'। এবারে 'হর ঘর তিরঙ্গা' ক্যাম্পেনের জন্য ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাগ কোড ২০০২ তে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা হয়।

প্যারাগ্রাফ ১.২ এর পার্ট-১ এ পরিবর্তিত করে করা হয়েছে, "The National Flag shall be made of hand-spun and handwoven or machine-made, cotton/ polyester/ wool/ silk khadi bunting.”।

অর্থাৎ এবারে মেশিনে নির্মিত পলিয়েস্টারের পতাকাও ব্যবহার করা যাবে পূর্বে যা নিষিদ্ধ ছিল।

প্যারাগ্রাফ ২.২ এর পার্ট-২ তে পরিবর্তন করা হয়,  "where the Flag is displayed in open or displayed on the house of a member of public, it may be flown day and night"।

অর্থাৎ, এখন সাধারণ নাগরিকেরা তাদের বাড়িতে দিবারাত্রি পতাকা ওড়াতে পারবে। আমরা জানি, আগে রাতে পতাকা নামিয়ে ফেলতে হত।

এই পরিবর্তন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কারণ এর ফলে মেশিন নির্মিত পলিয়েস্টারের পতাকা সহজেই বাজার ছেয়ে ফেলবে এবং খাদির ব্যবসা মার খাবে। খাদি সংস্থা এর প্রতিবাদে 'ধ্বজা সত্যাগ্রহ' পালনের ডাক দেয়। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কংগ্রেস ফ্ল্যাগ কোডের পরিবর্তনের বিরোধিতা করে বলে, প্রধানমন্ত্রী একদিকে 'মন কি বাত'-এ খাদি এবং দেশীয় জিনিস ব্যবহার করতে বলছেন অপরদিকে পলিয়েস্টারের পতাকা ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছেন যার ফলে খাদির ব্যবসা মার খাবে। অবশ্য মন্দ লোকে বলে, রিলায়েন্স গোষ্ঠী ভারতে পলিয়েস্টারের সবচেয়ে বড় উৎপাদক তাই তাদের সুবিধা করতেই এই পরিবর্তন করা হয়েছে। এমনকি পতাকা তৈরির উপর জিএসটিও মকুব করা হয়েছে। 


আজকের পুঁজিবাদী সমাজে দেশপ্রেমও অন্য সব কিছুর মতোই পণ্য। ফলে অমৃত মহোৎসবে 'পতাকা পুজো'র ব্যবসাও রমরমিয়ে হল। রিলায়েন্স থেকে অ্যামাজন সব ধনকুবের গোষ্ঠীই মুনাফা পেল। 'কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্সে'র হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩০ কোটি পতাকা বিক্রি হয়েছে এবং আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে এর ফলে সেল্ফ হেল্প গ্রুপে কাজ করা বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। 

এবার একটা অন্য হিসাব করা যাক, অবশ্য যদি ক্ষতির পরিমাণ আদৌ করা যায়। 

কনফেডারেশনের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে ৩০ কোটি পতাকা তৈরি হয়েছে। খুব সহজেই বোঝা যায় এর অন্তত এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ অন্তত ১০ কোটি পলিয়েস্টারের পতাকা। আমরা জানি ভারতে ১৫ আগস্ট পতাকা তোলা হয় তারপর দিন থেকেই অধিকাংশ পতাকা রাস্তা, ঘাটে, ডাস্টবিনে আবর্জনার মতো জমতে থাকে। কিন্তু কাগজ বা কাপড়ের পতাকা পচনশীল পদার্থে তৈরি বলে তা পরিবেশ দূষণের কারণ হয়না। কিন্তু পলিয়েস্টার পচনশীল পদার্থ নয় বলে তা প্রকৃতিতে মিশে যায়না। উপরন্তু পলিয়েস্টার তৈরির সময় কার্সিনোজেন, কোবাল্ট, অ্যান্টিমনি, ম্যাঙ্গানিজের বিভিন্ন রাসায়নিক লবণ, সোডিয়াম ব্রোমাইড, টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইডের মত বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয়। ফলে পলিয়েস্টারের পতাকা তৈরির কর্পোরেট স্বার্থ চরিতার্থ করতে যে বিপুল পরিমাণ পরিবেশ দূষণকে আহ্বান করা হল তার পরিমাপ কি পরিবেশ মন্ত্রক করতে পারবে। 

অবশ্য প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলেছেন সেখানে এসব 'ছোটখাটো' বিষয় নিয়ে ভাবতে তাদের বয়েই গেছে। 


কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে www.harghartiranga.com নামে একটা ওয়েবসাইটও চালু করা হয়েছে। 

জনতা সেখানে পতাকার সাথে নিজের সেলফি আপলোড করতে পারবে, এমনকি নিজের ঘরের ঠিকানা দিয়ে বাড়িতে পতাকা তুলে ছবি আপলোড করতে পারবে। এমনকি ওয়েবসাইট থেকে রীতিমতো সার্টিফিকেট ডাউনলোড করা যাবে। 'দেশপ্রেমে'র এমন হাতে গরম সার্টিফিকেট পাওয়া কি আর চাট্টিখানি ব্যাপার। 

তবে প্রোফাইল পিকচারে জাতীয় পতাকা লাগানোর আহ্বানে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ল বিজেপিরই মার্গ দর্শক সংগঠন আরএসএস। যারা সেই ১৯৪৭ সালে তেরঙ্গা পতাকাকে অশুভ বলে মেনে নিতে পারেনি, গেরুয়া পতাকার দাবি করেছিল, এমনকি ২০০২ সাল পর্যন্ত যাদের নাগপুরের হেড অফিসে জাতীয় পতাকা পর্যন্ত তোলেনি তারা উভয়সংকটে পড়ল। তাদের শ্রদ্ধেয়  গুরুজি গোলওয়ালকর বলে গেছিল, "Indian tricolour will never be respected and owned by the Hindus. The word three is in itself an evil, and a flag having three colours will certainly produce a very bad psychological effect and is injurious to a country. (Organiser issue July 1947)"

অথচ, বর্তমান ভারতে সেই বিজেপ-আরএসএসই কিনা দেশপ্রেমের 'ইজারা' নিয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও যখন আরএসএস এবং মোহন ভাগবতের মত প্রধান কার্যকর্তারা প্রোফাইলে পতাকা লাগালো না তখন দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠলো। ফলে সাপের ছুঁচো গেলার মত তারাও তেরঙ্গা লাগাতে বাধ্য হলেন। জানিনা হেডগেওয়ার এবং গোলওয়ালকরের 'ভূত' রাতে তাদের স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন কিনা!


কথায় বলে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ঘরে ঘরে তিরঙ্গা ওড়াতে হবে। ব্যস, সব দপ্তর তৎপর হয়ে গেল। রেলকর্মীদের কাছে ক্যাম্পেন সফল করতে মাইনে থেকে ৩৮ টাকা কাটার সার্কুলার জারি হল। 

কিছু কিছু ব্যাঙ্কও তার কর্মীদের ৫০ টাকা কাটার সার্কুলার জারি করেছে বলে জানা যায়। 

সারাদেশে এত কর্মচারীর বেতন থেকে যে কোটি কোটি টাকা কাটা হল সেটা সরকারের কোন অ্যাকাউন্টে জমা হল? সেই টাকা দিয়ে কোন সংস্থার থেকে কত দরে কত পতাকা কেনা হল? এই যে সংস্থাগুলো সরকারি ক্যাম্পেনে পতাকা সরবরাহের বরাত পেল তাদের টেন্ডার কবে কিভাবে ডাকা হল? এসব প্রশ্নের উত্তর কোনদিনই পাওয়া যাবেনা। সারাদেশের বিভিন্ন পোস্ট অফিস এবং রেশন দোকান থেকে জাতীয় পতাকা বিক্রির ব্যবস্থা হল। 


এরমধ্যেই হরিয়ানার কার্নালের রেশন দোকানের ঘটনা সারা দেশের সামনে চলে এল। সেখানে প্রান্তিক মানুষজনকে রেশন নিতে গেলে ২০ টাকা দিয়ে পতাকা কিনতে বাধ্য করা হচ্ছিল। রেশন ডিলারকে জিজ্ঞাসাবাদ করায় তিনি জানালেন 'উপর মহল' থেকে এলাকার রেশন ডিলারদের পতাকা কিনতে বাধ্য করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে কেউ পতাকা কিনতে না চাইলে তাকে রেশন দিতে হবেনা। খবরটি সামনে আসতেই বিজেপির সাংসদ বরুণ গান্ধী ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, "খুবই লজ্জার কথা। জাতীয় পতাকা তো মানুষের হৃদয়ে রয়েছে। তা কেনার জন্য মানুষের উপর জোরজুলুম করা হবে কেন? তেরঙ্গা না কিনলে যদি গরিব মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে তা সমর্থন করা যায়না।"

বরুণের টুইট সামনে আসতেই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। তৎক্ষনাৎ ঐ ডিলারের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হয়। খাদ্যদপ্তরের ডেপুটি কমিশনার অনীশ যাদব জানান, "সাধারণ মানুষ কে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত করার অপরাধে ঐ ডিলারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।"

কিন্তু, সত্যিই কি তাই??? 

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও মানুষের দারিদ্র্য এতটাই বেশি যে মাত্র ২০ টাকা খরচ করে পতাকা কেনা তার কাছে বিলাসিতা, এই দেশের জন্য এর থেকে লজ্জার আর কিইবা হতে পারে। 

কোন এক রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন দেশ মাটিতে নয়, মানুষে তৈরি, তাই দেশবাসী অভুক্ত থাকলে, বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে বন্দেমাতরম কাব্যকথায় দেশের লজ্জা ঘুচবেনা।

আজ এই বুভুক্ষু মানুষ যদি বিদ্রোহ করে বলে ওঠে, ভাত দে হারামজাদি নাহলে মানচিত্র ছিঁড়ে খাব, সেটা কি দেশদ্রোহ হবে প্রধানমন্ত্রী???

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ