২১ জানুয়ারি ২০২০:- পুরুলিয়া বাঘমুন্ডি ব্লকের কারিহাঁসা রামডি গ্রামে ডাইনি সন্দেহে বৃদ্ধা বেহুলা গোপ ও তার পরিবারকে হত্যার চেষ্টা।
২১ সেপ্টেম্বর ২০২১:- মহারাষ্ট্রের থানেতে কিশোরীর ঘাড়ে তারই কাকার ভূত ভর করেছে। ভূত তাড়াতে তান্ত্রিকের কথা মত কিশোরীকে ধর্ষণ করতে সাহায্য করল তার নিজেরই মা।
৫ নভেম্বর ২০২১:- কেরালার কান্নুরে জ্বরে ধুঁকতে থাকা ১১ বছরের ফতেমাকে ডাক্তার না দেখিয়ে ইমামের কাছে তুকতাক করালো তার বাবা। অকালে ঝরে গেল আরও একটা প্রাণ।
৭ ডিসেম্বর ২০২১:- বোলপুরে তান্ত্রিকের কথা মত এক যুবককে মদ্যপান করিয়ে তার জিভ কেটে উৎসর্গ করলেন দুই মহিলা।
১৬ মার্চ ২০২২:- উত্তরপ্রদেশের নয়ডার এক যুবকের বারবার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছিল। তান্ত্রিক পরামর্শ দেয় হোলির শুভদিনে কোন শিশুর বলি দিতে পারলে দোষ কাটবে। তান্ত্রিকের কথামত প্রতিবেশীর ৭ বছরের শিশুকে অপহরণ করে বলি দেয় যুবক।
৩ এপ্রিল ২০২২:- ঝাড়খন্ডের ছাতরা জেলায় ডাইনি অপবাদে এক কিশোরীকে চারদিন ঘরে আটকে ধুপ কাঠির ছ্যাঁকা দিয়ে অত্যাচার করে মৌলানা।
২৩ জুলাই ২০২২:- পূর্বস্থলীর ১ নং ব্লকের চাঁপাহাটি কেপিসি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রক্তমাখা ছুরি নিয়ে আক্রমণ করা ভূত দেখে আতঙ্কিত।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২:- বান্দোয়ানে ডাইনি ঘোষণা করে প্রায় ১ লাখ টাকা জরিমানা দেওয়ার নিদান দিল জানগুরু।
২৬ নভেম্বর ২০২২:- নদীয়ার তাহেরপুরে যুবককে নরবলির চেষ্টা করে দুই তান্ত্রিক। সেখান থেকে কোনক্রমে প্রাণে বাঁচলেও আশঙ্কাজনক অবস্থা, ঘাড়ে রামদা'র কোপের জন্য ৬০ টা সেলাই পড়ে।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩:- হুগলির দাদপুরচক কৃষ্ণপুর গ্রামে ডাইনি সন্দেহে পূর্ণিমা ও সনাতন দুর্লভকে নির্যাতন করে গ্রাম থেকে বিতাড়ন।
২৩ মার্চ ২০২৩:- উত্তরপ্রদেশের পারসা গ্রামে নিজের অসুস্থ সন্তানকে সুস্থ করতে তান্ত্রিকের কথা শুনে নিজের ১০ বছর বয়সী খুড়তুতো ভাইকে নরবলি দেওয়া হল।
২৫ মার্চ ২০২৩:- বীরভূমের সাঁইথিয়া থানার অন্তর্গত ন'পাড়া গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ আদিবাসী দম্পতি পান্ডু ও পার্বতী হেমব্রমকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা।
২৭ মার্চ ২০২৩:- কলকাতার তিলজলাতে সন্তান লাভের আশায় নি:সন্তান ব্যক্তি তান্ত্রিকের কথানুসারে ৭ বছরের শিশুকে অপহরণ করে হত্যা করে।
বর্তমান ভারতের সীমাহীন কুসংস্কারের সামান্য কয়েকটি উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম, যা একেবারেই হিমশৈলের চুঁড়া মাত্র। কিন্তু এই কুসংস্কারের ফলে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
আপনি বলবেন ওঝা, গুণিন, তান্ত্রিক। কেউ হয়তো বলবেন গেঁয়ো অশিক্ষিত লোকেরা ওঝা,তান্ত্রিকদের কাছে যায় বলেই মরে। কিন্তু এই কথা বলে আমরা তাদেরই আড়াল করে ফেলছি যারা এই অগণিত মৃত্যু (বলা ভালো হত্যার) দায় কোনভাবেই এড়াতে পারেনা, তারা হল মিডিয়া এবং প্রশাসন।
কটু সত্য এটাই যে ভারতীয় মিডিয়া (প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক) দেশে কুসংস্কার বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। টিভি সিরিয়ালে নানাভাবে দৈব মহিমা, ডাইনি, নাগিন দেখানো হচ্ছে যা সরাসরি শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মনে অন্ধবিশ্বাসের বীজ বপন করছে।
সংবাদপত্রে এবং টিভি চ্যানেলে 'ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অবজেকশনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট অ্যাক্ট'কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জ্যোতিষী, তান্ত্রিকদের বিজ্ঞাপন রমরম করে চলছে। আজকাল কিছু শহুরে ভূতান্বেষীদের আবির্ভাব হয়েছে যাদের পোশাকি নাম 'প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর'। এরা বিভিন্ন তথাকথিত ভূতুড়ে স্থানে তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হন এবং রীতিমতো "বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে" ভূতের প্রমাণ দেন। ভূতেরা এদের প্রশ্নের জবাব দেয়, রেগে গেলে পিঠে আঁচড় দেয়, মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা পাউডারের উপর হেঁটে গিয়ে নাকি নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণও রেখে যায়। মিডিয়া স্বাভাবিক ভাবেই এদের লুফে নিয়েছে। তারা মিডিয়াতে ভূতের অস্তিত্বের "বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা" দেয়। বিভিন্ন মিডিয়ায় যখন হরর মুভির মত ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড এফেক্টস দিয়ে এদের ভূত খোঁজার অভিযান দেখানো হয় তখন সেটা মানুষের মনে কুসংস্কার বাড়াতে বাধ্য। যদিও এরা সবাই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লিখে দেন "আমরা সমাজে কুসংস্কার বাড়াতে চাইনা/আমাদের চ্যানেল সবরকম কুসংস্কারের বিরুদ্ধে", কিন্তু সেটা সিগারেটের প্যাকেটে লেখা "সিগারেট খেলে ক্যান্সার হবে"র মতো ঠুনকো মেকি শব্দবন্ধ ছাড়া কিছুই নয়।
প্রশাসনও কোনভাবেই এই মৃত্যুগুলির দায় এড়াতে পারেনা। প্রকাশ্যে 'প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেশনে'র নামে এরকম প্রতারণা চলছে অথচ পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার। জ্যোতিষী, তান্ত্রিকরা পত্রপত্রিকায়, চ্যানেলে বসে বশীকরণ থেকে রোগমুক্তির দাবি করছে তাতেও প্রশাসনের কোন হেলদোল নেই। যুক্তিবাদী সমিতি এবং অন্যান্য বিজ্ঞান সংগঠনের পক্ষ থেকে বারংবার লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। ফলে ডাইনি সন্দেহে হত্যা, তান্ত্রিকের কথা শুনে শিশু বলি, কুসংস্কারের কারণে এই মৃত্যু মিছিল থামবেনা।
0 মন্তব্যসমূহ